একটু দূরে হুমায়ূনের লোকজন বালি সরিয়ে মরুকূপের সন্ধান করছে। আজ দিনের মতো পানি আছে। রাতে পানি লাগবে। কোথায় পাওয়া যাবে পানি?
হুমায়ূন কিছুক্ষণ কুপের বালি সরানো দেখলেন। কুপের বালি এখন ভেজা ভেজা। এর অর্থ হয়তো পানি পাওয়া যাবে। স্ত্রীকে এই আনন্দসংবাদ দেওয়ার জন্য হুমায়ূন হামিদা বানুর কাছে গেলেন। তিনি কিছু বলার আগেই হামিদা বানু বললেন, একদিন আমার খুব বেদানা খেতে ইচ্ছা করছিল। আপনি বেদানার ব্যবস্থা করেছিলেন। আজ আমার দুটা ইচ্ছা। আপনি আমার ইচ্ছা পূরণ করুন।
হুমায়ূন চিন্তিত গলায় বললেন, কী কী ইচ্ছা?
হামিদা বানু বললেন, প্রথম ইচ্ছা আমি স্নান করব। কতদিন গায়ে পানি দিই না। শরীর থেকে বিষাক্ত দুৰ্গন্ধ আসছে। দ্বিতীয় ইচ্ছা, আজ একটা তরমুজ আমি একা হাম হাম করে খাব। এই দুটা ইচ্ছা পূরণ করতে না পারলে তৃতীয় ইচ্ছা অবশ্যই পূর্ণ করতে হবে।
তৃতীয় ইচ্ছাটা কী?
তৃতীয় ইচ্ছা হচ্ছে, আপনি আমার পাশে হাত ধরে বসে থাকবেন। রোদে দাঁড়িয়ে কূপের বালি তোলায় তদারকির কিছু নেই।
হুমায়ূন স্ত্রীর পাশে বসেছেন, তখনই খবর এল যোধপুরের রাজা মালদেব দূত পাঠিয়েছেন। দূত সঙ্গে উপহার নিয়ে এসেছেন। উপহারের মধ্যে আছে ত্রিশ মশক সুপেয় পানি, হুমায়ূনের পছন্দের ফল তরমুজ এবং হামিদা বানুর সেবার জন্য একজন বাঁদি যে সন্তানপ্রসবের জটিল বিষয়টিতেও অভিজ্ঞ।
হুমায়ূন চার মশক পানি হামিদা বানুর স্নানের জন্যে বরাদ্দ করলেন। তরমুজ আলাদা করা হলো। স্নান শেষে হামিদা বানুকে তরমুজ দেওয়া হবে।
মালদেবের দূত হুমায়ূনকে কুর্নিশ করে বললেন, রাজা মালদেব তাঁর রাজ্যে আপনাকে নিমন্ত্রণ করছেন। আপনি যতদিন ইচ্ছা মালদেবের আতিথ্য গ্ৰহণ করবেন। শের শাহ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইলে আপনাকে সবরকম সামরিক সাহায্য দেওয়া হবে।
হুমায়ূনের আনন্দের সীমা রইল না। তিনি মালদেবের দূতকে জানালেন, আজ দিনের মধ্যেই তিনি রওনা হবেন।
দূত বলল, আপনার আগমনের সুসংবাদ আমি রাজা মালদেবকে জানাতে এক্ষুনি রওনা হব। আপনার স্ত্রী অসুস্থ। আপনি ধীরেসুস্থে আসুন।
হুমায়ূন দূতকে উপহার দিলেন রত্নবসানো একটি খঞ্জর।
হামিদা বানুর সেবার জন্যে যে বাঁদি পাঠানো হয়েছে তার নাম মিশা।
রুক্ষ কঠিন চেহারা। চোখে মায়ার লেশমাত্র নেই।
মালদেবের দূতের প্রস্থানের পরপরই মিশা হামিদা বানুকে বলল, আপনি আপনার স্বামীকে বলুন তিনি যেন কিছুতেই মালদেবের কাছে না যান। সেখানে শের শাহ্’র লোকজন বসে আছেন। আমাদের উচিত এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে অমরকোটের দিকে রওনা হওয়া। অমরকোটের রাজার বয়স অল্প এবং তিনি দয়ালু।
হামিদা বানু বললেন, তুমি মালদেবের পাঠানো বাঁদি। তুমি তাকে সাহায্য করবে। আমাদের সাহায্য করতে চোচ্ছ কেন?
মিশা বলল, আমি রাজপুত নারী। সম্রাট হুমায়ূন রাজপুত রানী কর্ণাবতীর জন্যে কী করেছিলেন সেই গল্প জানি। আমি একজন বীরের পক্ষ নেব নাকি কুচক্ৰী কাপুরুষ মালদেবের পক্ষ নেব?
হামিদা বানু বললেন, আমি স্নান করব। তরমুজ খাব। তারপর রওনা হব।
মিশা বলল, না। আমাদের হাতে সময় নেই।
হুমায়ূন অমরকোটে এসেছেন শুনে অমরকোটের রাজা নিজে তাঁকে অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে এলেন। রাজকীয় পন্থায় কুর্নিশ করতে-করতে বললেন, আমার পিতা জীবিত থাকলে তিনি নিজে এসে আপনাকে নিয়ে যেতেন। তিনি গত বছর যুদ্ধে নিহত হয়েছেন।
হুমায়ূন বললেন, আপনি হোসেনের পুত্র? আপনার পিতার মৃত্যুসংবাদে আমি ব্যথিত হলাম।
আমি ব্যথিত হচ্ছি। আপনার দৈন্যদশা দেখে।
হুমায়ূন বললেন, আমাকে দেখে কেউ ব্যথিত হলে আমি নিতে পারি। কেউ করুণা দেখালে সেটা নিতে পারি না।
আপনাকে করুণা করার স্পর্ধা আমার নেই। আমি অতি বিনয়ের সঙ্গে বলছি। আপনার স্ত্রীর সন্তান না হওয়া পর্যন্ত আপনি আমরকোটে থাকবেন। আমার পক্ষে সম্ভব সব সুযোগ-সুবিধা আপনি পাবেন।
হুমায়ূন বললেন, আমার প্রতি আপনার এই বদান্যতার কারণ জানতে পারি?
রাজা বললেন, আমি যা করছি আমার বাবা বেঁচে থাকলে তা-ই করতেন। বাহাদুর শাহ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় আমার বাবা আপনার সঙ্গে ছিলেন।
হুমায়ূন বললেন, আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। পরম করুণাময়ের করুণাধারা আপনার ওপর বর্ষিত হোক—এই শুভ কামনা।
অমরকোটের হাম্মামখানায় হামিদা বানু গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে বসে আছেন। মিশা তার গা ডালে দিচ্ছে। হাম্মামঘরেই কাটা তরমুজ রাখা আছে। হামিদা বানুর দৃষ্টি সেদিকে যতবার যাচ্ছে ততবারই তার চোখ ভিজে উঠছে। তার পেটের সন্তান খুব নড়াচড়া করছে। অকরুণ এই পৃথিবীতে আসার জন্যে সে ব্যস্ত হয়েছে। তার জন্যে কী অপেক্ষা করছে কে জানে!
১৫ অক্টোবর ১৫৪২ সালে এই অমরকোটেই হামিদা বানু একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। তার নাম রাখা হয় আকবর। পৃথিবীর ইতিহাসে এই আকবর তার স্থান করে নেন ‘আকবর দ্য গ্রেট’ হিসেবে। (আকবরের জন্মের তারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে। আবুল ফজলের দেওয়া তারিখের সঙ্গে জওহর আবিতাবিচির তারিখের অমিল আছে। জওহর আকবরের জন্মের সময় উপস্থিত ছিলেন। তার দেওয়া তারিখ সঠিক হওয়ার কথা। বলা হয়ে থাকে জাদুটোনার হাত থেকে রক্ষার জন্যে আকবরের আসল জন্মক্ষণ গোপন রাখা হয়েছে। হুমায়ূন জাদুটোনায় প্রবল বিশ্বাসী ছিলেন।)