হামিদা বানু হাতে বেদানা পেয়ে অবাক হয়ে বললেন, বেদানা কোথায় পেলেন?
হুমায়ূন বললেন, আমি হিন্দুস্থানের সম্রাট। আমার স্ত্রীর বেদানা খেতে ইচ্ছা করছে। আমি সামান্য একটা বেদানা জোগাড় করতে পারব না?
যোধপুরের রাজা মালদেবের কাছে শের শাহু-পুত্ৰ জালাল খাঁ একটি গোপন পত্র পাঠিয়েছেন। পত্রের বিষয় একসময়কার দিল্লীর সম্রাট হুমায়ূন। জালাল খাঁ লিখেছেন—
যোধপুরকে আমরা আমাদের বন্ধু রাজ্য বলে গণ্য করি। বন্ধুত্ব কখনো এক পক্ষীয় বিষয় না। আপনি আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছেন তা জানা প্রয়োজন।
আমাদের শক্তি সামর্থ্যের প্রমাণ আপনার চোখের সামনেই আছে। একসময়কার ক্ষমতাধর মোঘল সম্রাট আজ প্রাণভয়ে পথে-প্ৰান্তরে বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমরা আশা করি, আপনি যেভাবেই হোক পলাতক হুমায়ূনকে খুঁজে বের করবেন। আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজ রাজ্যে নিয়ে আসবেন। তার কাছে মহামূল্যবান হীরক কোহিনূর আছে। আপনি এই হীরকখণ্ড রেখে দেবেন। রত্নের উপর আমার পিতা বা আমার কোনো মোহ নেই। আমরা হুমায়ূনকে জীবিত অবস্থায় চাই।
আপনাকে যা জানানোর আমরা স্পষ্ট ভাষায় জানালাম। আপনি কী করবেন তা আপনার বিবেচ্য।
আপনার অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, হুমায়ূনের সব ভাইরা আমাদের সঙ্গে আছে।
ইতি জালাল খাঁ
মীর্জা কামরানের কাছে তার বোন গুলবদন বেগম এসেছে। তার হাতে কারুকার্যময় রুপার থালায় মিষ্টান্ন। গুলবদন বলল, ভাই মিষ্টি খাও।
মীর্জা কামরান বললেন, মিষ্টি খাওয়ার মতো বিশেষ কোনো ঘটনা কি ঘটেছে?
গুলবদন বলল, রাজপুরুষদের মিষ্টান্ন খেতে বিশেষ কোনো ঘটনার প্রয়োজন পড়ে না। তারপরেও ছোট্ট একটা উপলক্ষ আছে।
উপলক্ষটা কী?
আমি ভাই হুমায়ূনের মঙ্গল কামনা করে কোরান খতম এবং দোয়ায় ইউনূস খতম দিয়েছি। এই মিষ্টান্ন আমার নিজের হাতে বানানো।
মীর্জা কামরান বললেন, দোয়া দরুদে কি ভাগ্য পরিবর্তন হয়? তোমার আদরের ভাইয়ের জন্যে অনেকেই প্রার্থনা করছে। তার মধ্যে আমার নিজের মা’ও আছেন। ওনার ভাগ্য কি বদলেছে?
আল্লাহপাক যখন চাইবেন তখন ভাগ্য বদলাবে, তার আগে না। তারপরেও আমরা প্রার্থনা করি নিজেদের মনের শান্তির জন্যে।
তোমার বানানো মিষ্টান্নের একটি খেলে যদি তোমার মন শান্ত হয় তাহলে আমি মিষ্টি অবশ্যই খাব।
মীর্জা কামরান মিষ্টি মুখে দিতে-দিতে বললেন, তোমার আদরের ভাইয়ের বর্তমান অবস্থা জানতে চাও?
চাই।
সে সম্পূর্ণ আশাহত। সে মক্কা শরীফে চলে যেতে চাইছে। তাঁর এই সিদ্ধান্ত ভালো। শেষ বয়সে মক্কা শরীফে সন্ন্যাস জীবন।
আপনাকে এই খবর কে দিল?
তার দলত্যাগী আমীরদের একজন আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। গুলবদন বলল, আমি আমার ভাইকে একটি চিঠি লিখেছি। কোনোভাবে কি এই চিঠি তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব?
না।
আপনার নিজের হাতেও তো তিনি ধরা পড়তে পারেন, তখন কি তাকে পত্রটা দেওয়া যায় না?
মীর্জা কামরান জবাব দিলেন না। গুলবদন বলল, ওনাকে ধরার জন্যে আপনি অভিযানে যাচ্ছেন এই খবর আমি জানি। চিঠিটা এনে দিই, সঙ্গে রাখুন।
চিঠিতে কী লেখা?
খোলা চিঠি। আপনি ইচ্ছা করলে পড়ে দেখতে পারেন। বোন ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে লিখেছে। আনব?
মীর্জা কামরান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
হুমায়ূনকে লেখা গুলবদনের পত্ৰ
আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়, আমার নয়নের নয়ন ভাই হিন্দুস্থানের সম্রাট বাদশাহ হুমায়ূন।
ভাই, আপনার এই বোন আপনার জন্যে সারাক্ষণ প্রার্থনা করে যাচ্ছে। তার দিবস এবং রজনী আপনার করুণা কামনায় নিবেদিত।
এই চিঠি যদি আপনার হাতে না পৌঁছয় তাহলে বুঝতে হবে। আল্লাহপাক আপনার প্রতি করুণা করেন নি। আমরা সবাই তার ইচ্ছার অধীনে। ভাগ্যকে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই।
প্রিয় ভাই! আপনার কোমল মুখ একবার না দেখে যদি আমার মৃত্যু হয় তা হবে আমার জন্যে সপ্ত নরকের অভিশাপ।
প্রিয় ভাই! চিঠির অনেক লেখাই আপনার কাছে অস্পষ্ট লাগবে। আমার চোখের জলের কারণে এটা ঘটেছে। এই হতভাগ্য বোনের ভাইকে দেওয়ার মতো চোখের জল ছাড়া আর কিছুই নেই। গুলবদন
জওহর আবতাবচি
জওহর আবতাবচি, সম্রাট হুমায়ূনের ব্যক্তিগত পানিবাহক। তাঁর লেখা তাজকিরাতুন ওয়াকিয়াত গ্রন্থে রাজ্যহারা হুমায়ূনের সেই সময়ের কিছু করুণ চিত্ৰ আছে।
দ্বিপ্রহরে যাত্রা শুরু হলো। সেদিনের অবশিষ্ট দুই প্রহর, রাত্রির চার প্রহর এবং পরদিনের তিন প্রহর বেলা পর্যন্ত কাফেলাকে অব্যাহতভাবে চলতে হলো। পথিমধ্যে কোথাও পানি পাওয়া গেল না। পানির অভাবে দলের লোকজন মৃতকল্প হয়ে পড়ল। দিনের মাত্র এক প্রহর অবশিষ্ট ছিল। লোকেরা হয়রান পেরেশান হয়ে চারদিকে পানির খোঁজ করতে লাগল। এই সময় একটি মরুদ্বীপ নজরে পড়ল। সেখানে পানিভর্তি একটি জলাশয় দেখা গেল।
পানির অভাবে সেদিন অনেকেই মারা গিয়েছিলেন। জওহর আবতাবচির গ্রন্থে জানা যায় তাদেরকে সেখানেই দাফনের ব্যবস্থা করা হয়।
ক্যামব্রিজ হিস্টরি অব ইন্ডিয়া বইটিতে লেখা হয়েছে—মরুপথের এ সফরে পানির অভাবে সম্রাটের দলের বহু লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
মরুভূমির তীব্ৰ দাবদাহ
মরুভূমির তীব্ৰ দাবদাহ। বাতাসের সঙ্গে আগুন ছুটছে এমন অবস্থা হামিদা বানু খেজুরগাছের নিচে বসে আছেন। খেজুরগাছ ছায়াদায়িনী বৃক্ষ না। রোদে হামিদা বানুর শরীর পুড়ে যাচ্ছে। তাঁর ইচ্ছা করছে হাম্মামখানার শীতল জলে শরীর ড়ুবিয়ে বসে থাকতে। যেখানে খাওয়ার পানি নেই, সেখানে হাম্মামে স্নানের চিন্তার বিলাসিতার অর্থ হয় না। হামিদা বানু নিজের ওপর বিরক্ত হচ্ছেন।