প্রেতিযোনির হাত থেকে ব্যাপক সুরক্ষা গ্রহণের ফল। ফলেছে, হরিশংকর এখন আর খাটের উপর আকিকা বেগমকে পা বুলিয়ে বসতে দেখেন না। হরিশংকর ধর্মকর্মে ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছেন। ভোরবেলা গঙ্গাস্নান করেন। গঙ্গায় বুক পর্যন্ত ড়ুবিয়ে সূর্যপ্ৰণাম দিয়ে দিন শুরু করেন। মন্দিরে মন্দিরে ঘোরেন। সাধু-সন্তদের ধর্ম-উপদেশ শোনেন। দুপুরে কাকভোজন করান। কাকের রূপে আত্মারা মর্ত্যে ঘোরেন। কাকভোজন করালে আত্মাদের শান্তি হয়। পুণ্যলাভ হয়।
সন্ধ্যার পর হরিনাম শোনার পালা। হরির পবিত্র নাম শোনার মধ্যেও পুণ্য। হরিশংকরের পুণ্য সংগ্ৰহ চলতেই থাকে। তবে তিনি শারীরিকভাবে খানিকটা আচল হয়ে পড়েছেন। বা পায়ে কী-যেন হয়েছে। জায়গায় জায়গায় কালো হয়ে ফুলেছে। ব্যথা-বেদনা নেই, তবে স্পর্শানুভূতিও নেই। শুধু মাটিতে পা ফেললে যন্ত্রণায় অস্থির হন।
কুণ্ঠরোগের প্রধান লক্ষণ স্পর্শানুভূতি চলে যাওয়া। তার মতো পুণ্যবান মানুষের কুণ্ঠরোগ হওয়ার কোনোই কারণ নেই।
কাশির পথে পথে কুণ্ঠরোগীরা ছালা গায়ে বসে থাকে। তাদের সামনে থাকে ভিক্ষাপাত্র। কুণ্ঠরোগীদের কারোর কারোর হাত এবং পায়ের আঙুল পচে গলে হাড় বের হয়ে পড়েছে। সেখানে মাছি ভনভন করে। এই দৃশ্য হরিশংকরের সহ্য হয় না। তিনি নিয়মিত কাকভোজন করালেও কুণ্ঠরোগীদের প্রতি কোনো দয়া দেখান না। কুণ্ঠরোগীরা অভিশপ্ত। তাদের দয়া করলে পুণ্য অর্জন হয় না।
আজ শনিবার, অমাবস্যা। কালীপূজার যোগ পড়েছে। হরিশংকর সকাল সকাল ঘরে ফিরেছেন। কালীপূজার রাত শাক্তদের। অন্যরা এই সময় গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে থাকবে না, এটাই বিধি।
দরজা খুলে হরিশংকর হতভম্ব। আকিকা বেগম খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আকিকা বেগমের পাশে তার বান্ধবী অম্বা। দুজনের মুখ হাসি হাসি। অম্বা পরিচিতজনের মতো করে বলল, কেমন আছেন?
হরিশংকর মনে মনে রাম নাম জপ করতে লাগলেন। প্রশ্নের জবাব দিলেন না। প্রেতিযোনির প্রশ্নের জবাব দিতে নেই। জবাব দিলে তারা পেয়ে বসে। অম্বা বলল, আপনার পায়ে কী হয়েছে? কুণ্ঠ?
হরিশংকর বললেন, কুষ্ঠ কেন হবে। বাত হয়েছে বাত। অমাবস্যা পূর্ণিমায় বাতের ব্যথা বাড়ে। আজ অমাবস্যা। বাতের প্রকোপের এই কারণেই বৃদ্ধি।
প্রেতিযোনির সঙ্গে কথাবার্তায় জড়াতে নেই—এই সত্য জেনেও হরিশংকর কথাবার্তা শুরু করেছেন। তিনি আবারও রাম নামে ফিরে গেলেন।
আকিকা বেগম বলল, আমার বাবা দিল্লীর সম্রাট পাদশাহ হুমায়ূন কোথায়?
আমি জানি না।
আকিকা বলল, আপনি কেন জানেন না?
হরিশংকর মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন।
হুমায়ূন আছেন যোধপুর রাজ্যের সীমানার একটি পরিত্যক্ত গ্রামে। গ্রামের নাম ভকুর। সেইসময় মাঝে মাঝেই কিছু জনপদ পরিত্যক্ত হতো। ডাকাতের আক্রমণ, পাশের কোনো রাজ্যের রসদ সংগ্ৰহ অভিযানের কারণে এটা ঘটত। মহামারি তো আছেই। মহামারীতে জনপদের পর জনপদ উজাড় হওয়ার মতো ঘটনা নিয়মিতই ঘটত।
হামিদা বানু একটি মাটির ঘরের বারান্দায় দেয়ালে হেলান দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। একটু দূরে মশাল জ্বালানো হয়েছে। মশাল ঘিরে পোকা নাচানাচি করছে। তাদের কেউ কেউ সরাসরি আগুনে ঢুকে পড়ায় পট পট শব্দ হচ্ছে। হামিদা বানু পোকাদের খেলা দেখছেন।
রাতের খাবার হিসেবে লবণ দিয়ে গম সিদ্ধ করা হচ্ছে। ভগ্নহৃদয় হুমায়ূন অন্য আরেকটি ঘরের বারান্দায় আফিম খাচ্ছেন। তাঁর সৈন্যদের বেশির ভাগ তাকে ছেড়ে গেছে। বৈরাম খাঁ ছাড়িয়ে দিয়েছেন। কারণ তাদের বেতন দেওয়ার সামর্থ্য হুমায়ূনের নেই। আমীরদের মধ্যে পাঁচজন এখনো আছেন।
হুমায়ূন দূর থেকে লক্ষ করলেন, হামিদা বানু কী যেন খাচ্ছেন। বেশ আরাম করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া। হামিদা বানুর সঙ্গে কোনো খাবার নেই। কৌতূহলী হয়ে হুমায়ূন। এগিয়ে গেলেন।
কী খাচ্ছ?
হামিদা বানু লজ্জিত গলায় বললেন, খুব বেদানা খেতে ইচ্ছা করছিল। তাই বেদানা খাচ্ছি।
বেদানা কোথায় পেলে?
কোথাও পাই নি। কল্পনায় খাচ্ছি।
হুমায়ূন দুঃখিত হয়ে লক্ষ করলেন, হামিদা বানু কল্পনার বেদানা ভেঙে দানা মুখে দেওয়ার ভঙ্গি করছেন। দানা কিছুক্ষণ চিবানোর পর থু করে বিচি দূরে ফেলে দিচ্ছেন।
হামিদা বানু বললেন, জাহাঁপনা, বেদানা খুব মিষ্টি। কয়েকটা দানা খেয়ে দেখবেন?
হুমায়ূন বললেন, এই ছেলেখেলার কোনো মানে হয়?
হামিদা বানু বললেন, ছেলেখেলা ছাড়া আমাদের এখন কী আর আছে?
হুমায়ূন মাথা নিচু করে স্ত্রীর সামনে থেকে বের হয়ে এলেন। তখন একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। সম্রাট হুমায়ূনের সব জীবনীকার এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। আবুল ফজলের গ্রন্থেও এর উল্লেখ আছে। ঘটনাটা এ রকম–
হুমায়ূন স্ত্রীর সামনে থেকে বের হয়ে কিছুদূর এগুতেই অপরিচিত এক লোক তাঁকে কুর্নিশ করল। হুমায়ূন বললেন, আপনি কে?
সে বলল, আমি দুৰ্ভাগ্যতাড়িত এক ব্যবসায়ী। ডাকাতরা আমার সর্বস্ব নিয়ে গেছে। এখানে আগুন জ্বলছে দেখে এসেছি। আমি তৃষ্ণার্তা এবং ক্ষুধার্ত।
হুমায়ূন বললেন, আমি আপনার চেয়ে খুব ভালো অবস্থায় নেই। তৃষ্ণ নিবারণ করুন। খাদ্য প্রস্তুত হচ্ছে, আমাদের সঙ্গে খাদ্য গ্ৰহণ করুন।
বণিক বলল, আমার কাছে কিছুই নেই। যা দিয়ে একজন সম্রাটকে সম্মান জানানো যায়। আমার সঙ্গে বড় একটা বেদানা আছে। যদি গ্ৰহণ করেন।
বণিক থলে থেকে বিশালাকৃতির একটা বেদানা বের করল। পেকে লাল টুকটুক করছে।