আসুন আমরা বাদশাহ নামদারের জগতে ঢুকে যাই। মোঘল কায়দায় কুর্নিশ করে ঢুকতে হবে কিন্তু।
নকিব বাদশাহর নাম ঘোষণা করছে—
আল সুলতান আল আজম ওয়াল খাকাল আল মুকাররাম, জামিই সুলতানাত-ই-হাকিকি ওয়া মাজাজি, সৈয়দ আল সালাতিন, আবুল মোজাফফর নাসির উদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ূন পাদশাহ, গাজি জিলুল্লাহ।
এগারো সংখ্যাটি সম্রাট বাবরের প্রিয়
এগারো সংখ্যাটি সম্রাট বাবরের প্রিয়। তিনি যখন শরাব পানের আসরে বসেন, তখন তাঁর সঙ্গী থাকে দশজন। খাবার খেতে যখন বসেন তখনো দশজনকে নিয়েই বসেন। তাকে নিয়ে সবসময় সংখ্যা হয় এগারো। বেজোড় সংখ্যা। আল্লাহপাক বেজোড় সংখ্যা পছন্দ করেন।
প্রভাতী মদ্যপানের আসর বসেছে। এই আসরের নাম সাবহী (প্ৰভাত মদ্য)। যথারীতি দশজন আমীর আছেন। তাদের সামনে রুপার পানপত্র। সম্রাটের সামনে স্বর্ণের পানিপাত্র। তারা ‘দমীহ নামের শরাব খাচ্ছেন। ‘দমীহ এসেছে পারস্য থেকে। এক বিশেষ ধরনের গাছের শিকড় এবং মধু থেকে দমীহ তৈরি হয়। দমীহ কিছুক্ষণের মধ্যে নেশার আবেশ তৈরি করে, তবে সহজে মত্ততা আনে না।
পান শুরু হওয়ামাত্র প্রধান উজির মীর খলিফা ঢুকলেন। সম্রাটের ভুরু কুঞ্চিত হলো। মীর খলিফা ধমীয় অনুশাসন কঠিনভাবে মানেন। শরাব খান না। পানের আসরে এ ধরনের মানুষের উপস্থিতি সম্রাটের अछन की।
মীর খলিফা বললেন, আমি সম্রাটের সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলতে আগ্রহী।
সম্রাট বললেন, উজির, আপনার সময় নির্বাচন ভুল হয়েছে। উজির বললেন, সময়ের ভুল শুদ্ধ নেই। মানুষ ভুল শুদ্ধের অধীনে বাস করে। সময় করে না।
এই মুহুর্তে একান্তে কথা বলা জরুরি?
জরুরি।
যাঁরা আমার সঙ্গে আছেন তারা আমার আপনজন। আমাকে যা বলা যাবে, তাদেরকেও বলা যাবে।
উজির বললেন, আমার যা বলার তা আমি আপনাকেই বলব। আপনার ইচ্ছা হলে পরে আপনি আপনার প্রিয়জনদের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন। এখন না।
সম্রাট হাত ইশারা করতেই আমীররা উঠে গেলেন। তাদেরকে বিচলিত মনে হলো।
উজির বললেন, কিছুক্ষণ আগে খবর পেয়েছি হুমায়ূন মীর্জা তাঁর সমস্ত সেনাদল নিয়ে আগ্রার দিকে ছুটে আসছেন।
হুঁ।
বাদাখ্শান্ অরক্ষিত। হুমায়ূন মীর্জা বাদাখশান সুরক্ষার জন্যে কোনো ব্যবস্থাই করেন নি।
হুঁ।
কামরাম মীর্জার সঙ্গে হুমায়ূনের কাবুলে দেখা হয়েছে। কামরান তাঁর বড়ভাইয়ের হঠাৎ করে আগ্রা রওনা হওয়ার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। হুমায়ূন কোনো জবাব দেন নি।
হুঁ।
বাদাখশান্য অরক্ষিত রেখে হুমায়ূন হিন্দুস্তান যাত্রা করেছেন দেখে কামরান যাচ্ছেন বাদাখশানে। তিনি বাদাখশানের দুর্গ রক্ষা করবেন।
হুঁ।
এদিকে অরক্ষিত বাদাখশানের দখল নেওয়ার জন্যে আপনার চিরশত্রু সুলতান সাঈদ খান রওনা হয়ে গেছেন। আমার যা বলার ছিল বলেছি। আপনার প্রভাতী পানাহারের বিঘ্ন করেছি বলে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
বাবর দমীহতে চুমুক দিলেন। তাঁকে তেমন বিচলিত মনে হলো না। তিনি হালকা গলায় বললেন, হুমায়ূন হঠাৎ কেন এদিকে আসছে বলে আপনার ধারণা? সে কি সিংহাসন চায়?
মীর খলিফা বললেন, সিংহাসন চাওয়াটাই স্বাভাবিক। ধরে নিলাম সিংহাসন তার চিন্তায় নেই, তারপরেও আপনাকে কিছু না জানিয়ে বাদাখশান্য অরক্ষিত রেখে তার যাত্রা গৰ্হিত হয়েছে।
সম্রাট বললেন, এমনও তো হতে পারে হঠাৎ এদিকে আসার তার বিশেষ কোনো কারণ ঘটেছে।
উজির শীতল গলায় বললেন, সম্রাটকে মনে করিয়ে দিতে চাই, আপনার এই পুত্ৰ দিল্লীর রাজকোষ লুণ্ঠন করে পালিয়ে গিয়েছিল।
হুঁ।
আপনি তিল তিল করে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছেন। যোগ্য হাতে এই সাম্রাজ্য রক্ষার ভার দিয়ে যাওয়া আপনার কর্তব্য।
আপনার কাছে যোগ্য কে বলে মনে হয়?
অবশ্যই কামরান মীর্জা। হুমায়ূন মীর্জা অলস এবং আরামপ্রিয়।
হুঁ।
সম্রাটকে জানাতে চাই, প্রধান উজির হিসেবে সম্রাটের সেবা এবং সাম্রাজ্যের সেবা ছাড়া আমার কোনো উদ্দেশ্য নাই। অতীতেও ছিল না। ভবিষ্যতেও থাকবে না।
উজির ভক্তিভরে সম্রাটের হাতে চুম্বন করলেন। সম্রাট বললেন, আপনি কখনোই আমাকে কোনো ভুল পরামর্শ দেন নাই। আপনার কর্মে আমি উপকৃত, আমার সাম্রাজ্য উপকৃত।
মীর খলিফা বললেন, আপনাকে এই মুহুর্তে আমি একটি পরামর্শ দিতে চাচ্ছি। আপনি বিচক্ষণ সম্রাট, আমার এই উপদেশ গ্ৰহণ করলে উপকৃত হবেন।
কী পরামর্শ?
রাজকীয় ঘোড়সওয়ার বাহিনী হুমায়ূন মীর্জার গতিরোধ করবে এবং তাঁকে গ্রেফতার করে সম্রাটের সামনে উপস্থিত করবে। আপনি তাঁকে প্রশ্ন করবেন। এই সময়ে বাদাখশান শত্রুর হাতে ফেলে তিনি কেন চলে এসেছেন?
আপনার ধারণা এটি সঠিক সিদ্ধান্ত?
অবশ্যই এটি সঠিক সিদ্ধান্ত।
সম্রাট বাবর বললেন, সঠিক সিদ্ধান্তের ক্ষমতা আছে শুধুই আল্লাহপাকের। মানুষকে মাঝে মাঝে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে সে মানুষ। হুমায়ূন মীর্জা যেন নির্বিঘ্নে দিল্লী আসতে পারে এই ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হলো।
উজির কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হতাশ গলায় বললেন, সম্রাটের আদেশ এই দাসানুদাসের শিরোধার্য।
মীর খলিফা উঠে যাওয়ার পর ভগ্ন পান-উৎসব আবার শুরু হলো। উজবেকিস্তানের এক গায়িকা আসহারির জাদুকরী কণ্ঠের কথা সম্রাট শুনেছেন। তার গান শোনা হয় নি। প্রভাতী পান-উৎসবে গায়কগায়িকাদের কখনো আনা হয় না। সম্রাটের ইচ্ছায় আজ আসহারিকে আনা হলো। সে কিন্নর কণ্ঠে তুকী ভাষায় গান ধরল—