উছি বেগ : না।
বৈরাম খাঁ : তাহলে কী করে বুঝবেন এটিই মহামূল্যবান কোহিনূর?
উছি বেগ : আমার এখানে একজন রত্নব্যবসায়ী আছে। সে চিনবে।
বৈরাম খাঁ : আপনি তাহলে আগে থেকেই প্রস্তুত। কোহিনূরের জন্যে এই কাণ্ড করছেন?
উছি বেগ : আপনার অনুমান সঠিক। কোহিনূর আগে আমার হাতে পৌঁছতে হবে। পানি এবং রসদ, পাথর হাতে পাওয়ার পর সরবরাহ করা হবে।
বৈরাম খাঁ : পাথর আপনি নিজে নেবেন? নাকি আমাকে নিয়ে আসতে হবে?
উছি বেগ : আপনি নিয়ে আসবেন। রত্নব্যবসায়ী আপনার সঙ্গে যাবে। সে রত্ব ঠিক আছে কি না দেখে নেবে।
বৈরাম খাঁ : রত্নব্যবসায়ীকে আমার সঙ্গে দিন। আমি পাথর নিয়ে ফিরছি। আমাকে কিছু সময় দিতে হবে। কোহিনূর বিশেষ জায়গায় লুকানো। খুঁজে বের করতে সময় নেবে। এর মধ্যে আপনি পানি এবং রসদের ব্যবস্থা করুন।
উছি বেগ : বিলম্ব হলে সমস্যা নেই।
রত্নবণিকের নাম মহাবীর। সে জাতিতে জৈন, পরম অহিংস। মুখেনাকে পাতলা কাপড় পরে রাখে, যেন মশা-মাছি নাকে-মুখে ঢুকে মারা না যায়। মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটে যেন পায়ের নিচে পড়ে পিঁপড়া মারা না যায়।
রত্নবণিককে দুর্গে ঢুকিয়েই দুর্গের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো। বৈরাম খাঁ বললেন, আমরা যে মহাবিপদে পড়েছি তা কি বুঝতে পারছেন?
মহাবীর বলল, আমি ব্যবসায়ী মানুষ এইসব কিছু বুঝি না। কোহিনূর আমাকে দেখাবেন। আমি বলব আসল জিনিস কিংবা নকল। আমার কাজ শেষ।
বৈরাম খাঁ বললেন, আপনি মন দিয়ে আমার কথা শুনুন। পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী হলো আহত ব্যাঘ। আমি আহত ব্যাঘ।
খাঁ সাহেব, গেট খুলে দেন। আমি অহিংস মানুষ। পিঁপড়া পর্যন্ত মারি না।
আপনাকে পিঁপড়া মারতে হবে না। খামাখা পিঁপড়া কেন মারবেন? আপনি দেখবেন আমরা কী করে মানুষ মারি।
খাঁ সাহেব, গেট খুলে দেন।
এক্ষুনি গেট খুলে দেব। আমরা দুজন গেট দিয়ে বের হব। আমার হাতে থাকবে রেশমি রুমালের ভেতর সাধারণ একখণ্ড পাথর। আমি রুমাল উঁচু করে উছি বেগের তাঁবুর দিকে এগুতে থাকব। উছি বেগ তাঁবু থেকে ছুটে আসবে। আর তখনই আমার তীরন্দাজরা তাকে মারবে। উছি বেগের মৃত্যু বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর আমার ঘোড়সওয়ার বাহিনী বের হবে। কিছুক্ষণ যুদ্ধ হবে। আপনি মানুষের মৃত্যু দেখবেন।
হতভম্ব মহাবীর বলল, আপনার লোক যখন তীর ছুঁড়বে সেই তীর তো আমার গায়েও লাগতে পারে।
সম্ভাবনা আছে, তবে আমার তীরন্দাজদের হাতের নিশানা ভালো। তাদের উপর ভরসা রাখতে পারেন।
পরের অংশ সংক্ষিপ্ত। উছি বেগ প্রথম তীরের আঘাতেই ধরাশায়ী হলেন। তার দলের লোকদের হতভম্ব ভোব কাটার আগেই বৈরাম খাঁ’র বাহিনী বের হয়ে এল। ভারতবর্ষে সেনাপতির মৃত্যু মানেই যুদ্ধে পরাজয়। উছি বেগের লোকজন পালাতে শুরু করেছে। বৈরাম খাঁ’র জন্যে একটি ঘোড়া এবং তরবারি নিয়ে আসা হয়েছে। বৈরাম খাঁ লাফ দিয়ে ঘোড়ায় উঠতেই যুদ্ধ শেষ।
হুমায়ূন তাঁর বাহিনী নিয়ে নির্বিঘ্নে সিন্ধুনদ পার হলেন। উছি বেগের সৈন্যদের কাছ থেকে পাওয়া রসদ এবং পানির এখন আর অভাব নেই।
হামিদা বানুকে নৌকায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। তিনি একবার বললেন, আমরা কোথায়?
হুমায়ূন বললেন, সিন্ধুনদ পার হচ্ছি।
পানি খাব।
হুমায়ূন বললেন, যত ইচ্ছা পানি খাও। পানির অভাব নেই।
মহাবীর তীরবিদ্ধ হয় নি। সে বৈরাম খাঁ’র সঙ্গে আলাদা নৌকায় উঠেছে। মহাবীর বৈরাম খাঁ’র দিকে তাকিয়ে বলল, আমার নাম মহাবীর কিন্তু আপনি সত্যি মহাবীর এবং অতি বিচক্ষণ।
বৈরাম খাঁ হাই তুলতে-তুলতে বললেন, মানুষ মারা দেখে মজা পেয়েছে?
মহাবীর বলল, এইসব কী বলেন? আমরা অহিংস জাতি। পিঁপড়া পর্যন্ত মারি না।
বৈরাম খাঁ বললেন, আপনি আমাদের সঙ্গে জুটেছেন কী জন্যে?
কোহিনূর হীরা এক নজর দেখে জীবন সার্থক করার ইচ্ছা। সুযোগ কি পাব?
অবশ্যই পাবেন। তবে আগে কয়েকটা পিঁপড়া মারতে হবে। পারবেন?
মহাবীর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা পিঁপড়া মারতে রাজি আছি। এর বেশি পারব না।
বৈরাম খাঁ বললেন, পিঁপড়া মারতে হবে না। পিঁপড়া মারা ছাড়াই আপনাকে কোহিনূর দেখাব। তবে কোহিনূর সামান্য পাথর ছাড়া কিছু না। জীবন্ত সঠিক মানুষ হলো আসল কোহিনূর। পেছনের নৌকার দিকে তাকান। রাজ্যহারা সম্রাট হুমায়ূন স্ত্রীর হাত ধরে বসে আছেন। উনিই আসল কোহিনূর। দেখেছেন?
হুঁ। আপনারা যাচ্ছেন কোথায়?
শুধুমাত্র নদী জানে সে কোনদিকে যাচ্ছে। তার যাত্রা সমুদ্রের দিকে। মানুষ নদী না বলেই সে কোনদিকে যাচ্ছে তা জানে না।
মহাবীর বলল, আপনার সাহস এবং বীরত্ব দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আমি অর্থের যোগান দেব, আপনি সৈন্য সংগ্ৰহ করবেন। সৈন্য হচ্ছে তীর্থের কাক। ভাত ছিটালেই আসে।
বৈরাম খাঁ বললেন, অর্থের বিনিময়ে আপনাকে কোহিনূর দিতে হবে?
হুঁ।
বৈরাম খাঁ বললেন, শুনুন মহাবীর। কোহিনূর বিক্রি হয় না। এটা উপহার হিসেবে পাওয়া যায় কিংবা তলোয়ারের সাহায্যে কেড়ে নিতে হয়। আর কথা না বলে নদীর শোভা দেখুন।
আচার্য হরিশংকর
প্রেতযোনির হাত থেকে নিজেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা আচার্য হরিশংকর করেছেন। তান্ত্রিকের কাছ থেকে ‘রাম কবচ নিয়েছেন। গলায় পরেছেন অষ্টধাতু রক্ষাকবচ। তাঁর বিছানার নিচে সরিষা দানা, দরজায় বুলিছে লোহার শিকল। প্রেতিযোনি সরিষা এবং লোহা ভয় পায়। তারা আগুনও ভয় পায়। হরিশংকরের খাটের নিচে মাটির মালশায় দিনরাতই কয়লার আগুন জ্বলে। সারাক্ষণ আগুন জ্বলিয়ে রাখার জন্যে তিনি বয়রা নামে এক কিশোরকে চাকরি দিয়েছেন।