চতুর্থ এবং শেষ প্রশ্ন, আপনি কি চান আপনার মহান স্বামী যে মোঘল রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা টিকে থাকুক?
হ্যাঁ।
তাহলে আমি যা করছি তার বিকল্প নেই। আমি লাহোরে শক্তি সংগ্রহ করব।
তুমি তোমার বড়ভাইয়ের পাশে দাঁড়াবে না?
মীর্যা কামরান বললেন, অন্যের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে আমি নিজেকে জড়াব না।
এই ভাই তোমার প্রতি যে মমতা দেখিয়েছে তা তুমি বিস্মরণ হয়েছ?
মমতা দুর্বলের অস্ত্ৰ। আমি দুর্বল না।
গুলারুখ বেগম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এর অর্থ কি এই যে তুমি তোমার ভাইকে শক্রর হাতে তুলে দেবে?
মীর্জা কামরান চুপ করে রইলেন। গুলারুখ বেগম কঠিন গলায় বললেন, মা হিসেবে তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ-ভাইকে শের শাহ’র হাতে তুলে দেওয়ার আগে তুমি নিজ হাতে তাকে হত্যা করবে। তোমার প্রতি সে যে মমতা এবং ভালোবাসা দেখিয়েছে এটা হবে তার পুরস্কার।
মেয়েলি কথাবার্তা শোনার সময় আমার নেই মা।
তোমার ভাই কিন্তু শুনতো।
শুনে শুনেই তো আজ তাঁর এই অবস্থা। শিয়ালের মতো সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে তাড়া করছে শিকারি কুকুর।
তার মতো শিয়াল হতে পারা মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আচ্ছা তুমি রওনা হও। তোমাকে দেরি করিয়ে দিলাম।
হুমায়ূন আছেন সিন্ধুর নাদান দুর্গে। এই দুর্গের প্রধান উছি বেগ দুর্গ হুমায়ূনের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে দুর্গের বাইরে অবস্থান নিয়েছেন। উছি বেগের উদ্দেশ্য পরিষ্কার না। এটা কি কৌশলে হুমায়ূনকে বন্দির চেষ্টা? হুমায়ূন দুর্গে বন্দি থাকবেন। শের শাহ’র কাছে খবর যাবে। বিশাল পুরস্কারের বিনিময়ে উছি বেগ হুমায়ূনকে তুলে দেবেন শের শাহ’র হাতে?
হামিদা বানু দুর্গের একটি কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এই বিশ্রাম তার জন্যে প্রয়োজন ছিল। এই মুহুর্তে তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন না। তাঁর শরীর খুবই খারাপ করেছে। গায়ে প্রবল জ্বর। সেবা করার কেউ নেই।
বৈরাম খাঁ’র হাতে এখন সৈন্যসংখ্যা মাত্র নয় শ’। তবে এরা সবাই সুশিক্ষিত। এক শ’ তীরন্দাজ আছে, যাদের নিশানা অব্যৰ্থ। বৈরাম খাঁ দুর্গপ্রাচীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় তাদের বসিয়ে দিয়েছেন। ঘোড়সওয়ার বাহিনী দুর্গের মূল ফটকের কাছে রাখা হয়েছে। পাথরের তৈরি দুর্গ হালকা কামান দেগেও কিছু করা যাবে না।
উছি বেগের সঙ্গে বৈরাম খাঁ বৈঠকে বসেছেন। উছি বেগের উদ্দেশ্য যদি ধরা যায়। উছি বেগ বারবারই বলছেন-আমি একজন বিপদগ্ৰস্ত রাজ্যহারা মানুষকে সাহায্য করছি, এর বেশি কিছু না।
বৈরাম খাঁ বললেন, বিপদগ্ৰস্ত মানুষকে সাহায্য করতে দেখা যায় কিন্তু রাজ্যহারা মানুষকে কেউ সাহায্য করে না।
উছি বেগ বললেন, কেউ করে না তা ঠিক না, আমি তো করছি।
আপনি কি পুরস্কারের আশায় এই কাজ করছেন?
না। ভালো কাজ পুরস্কারের লোভে কেউ করে না।
বৈরাম খাঁ বললেন, আপনার মহানুভবতায় আমি মুগ্ধ। কোনো এক শুভক্ষণে সম্রাট হুমায়ূন নিশ্চয়ই আপনাকে পুরস্কৃত করবেন।
আপনারা যত দিন ইচ্ছা এই দুর্গে থাকবেন। দুর্গে রসদ নেই, পানি নেই। আমি ব্যবস্থা করছি। হাম্মামখানায় কিছু পানি আছে, তাতে আজকের রাতটা চলবে। ভোর হোক, সব ব্যবস্থা হবে।
আল্লাহপাক আপনার মঙ্গল করুন।
হাম্মামখানায় পানি পাওয়া গেল না। হাম্মামখানার কল খোলা, সব পানি বের হয়ে গেছে। দুর্গের রসদঘর শূন্য। একদানা চাল বা গম পাওয়া গেল না। বৈরাম খাঁ প্ৰমাদ গুনলেন। তিনি নিশ্চিত উছি বেগের উদ্দেশ্য ভাল না।
ভোরবেলা রসদ বা পানি কোনোটাই এল না। পানিশূন্য অবস্থায় সারা দিন কাটল। জওহর আবিতাবিচির সংগ্রহে দুই মশক পানি আছে। হুমায়ূনের প্রয়োজন মিটবে, কিন্তু অন্যদের কী হবে? বৈরাম খাঁ উছি বেগের সঙ্গে বিশেষ বৈঠকের ব্যবস্থা করলেন। উছি বেগ দুর্গের ভেতর আসতে রাজি হলেন না। বৈঠক হবে উছি বেগের তাঁবুতে। বৈরাম খাঁ তাতেই রাজি। নিরস্ত্র অবস্থায় তিনি উছি বেগের তাঁবুতে ঢুকলেন। তাদের কথোপকথন
বৈরাম খাঁ : সম্রাট-পত্নী হামিদা বানু সন্তানসম্ভবা। তিনি অসুস্থ। প্রবল জ্বরে কাতর।
উছি বেগ : শুনে দুঃখিত হলাম। আমার সঙ্গে কোনো চিকিৎসক নেই। থাকলে পাঠিয়ে দিতাম।
বৈরাম খাঁ : দুর্গে পানি নেই। খাবার নেই।
উছি বেগ ; আমি এই বিষয়ে কিছু করতে পারছি না। চেষ্টা করেও সংগ্ৰহ করতে পারি নাই। আমাদেরও খাদ্য-পানির সংকট।
বৈরাম খাঁ : বাদশাহ হুমায়ূন আপনার কাছে একটা প্রস্তাব উপস্থিত করতে আমাকে বলেছেন। তিনি নিজ পত্নীর অবস্থা দেখেই এমন একটা প্রস্তাব করছেন।
উছি বেগ : বলুন কী প্রস্তাব।
বৈরাম খী : উনার সঙ্গে একটি বহু মূল্যবান রত্ন আছে। রত্নটি আপনি উপহার হিসেবে পাবেন।
উছি বেগ : রত্নটির নাম কি কোহিনূর?
বৈরাম খাঁ : হ্যাঁ, কোহিনূর। আপনি খোঁজখবর ভালোই রাখেন। দুর্গপ্রধান না হয়ে আপনার রাজ্যপ্রধান হওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, সম্রাটের একটি শর্ত আছে।
উছি বেগ : শর্ত দেওয়ার মতো অবস্থায় আপনার সম্রাট নেই, তার পরেও শুনি।
বৈরাম খাঁ : আপনি আমাদের সিন্ধুনদ পার হওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। পানি এবং রসদ সরবরাহ করবেন।
উছি বেগ : কোহিনূর কখন পাব?
বৈরাম খাঁ : পানি এবং রসদ নিয়ে আপনার লোকজন ঢুকবে। তাদের সঙ্গে আপনিও দুর্গে ঢুকবেন। তখনই আপনার হাতে কোহিনূর দিয়ে দেওয়া হবে। আপনি কি রত্ন চেনেন?