হামিদা! কবিতাটা আমার মনে নেই।
একটা লাইনও মনে নেই?
না।
মনে করার চেষ্টা করুন। আজ রাতে আমি আপনার কাছ থেকে কবিতা শুনবই। যদি মনে না পড়ে নতুন কবিতা লিখবেন। কলমচিকে কাগজ-কলম নিয়ে আসতে বলুন। চাঁদের আলো তীব্ৰ। এই আলোতে লিখতে আপনার অসুবিধা হবে না।
হামিদা! তোমাকে খুব অস্থির লাগছে। কী হয়েছে বলো তো?
আপনার মুখ থেকে কবিতা শুনতে ইচ্ছা করছে। এর বেশি কিছু না।
হুমায়ূন বললেন, আমি কি তোমাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?
হামিদা বানু বললেন, সম্রাট কখনো অনুরোধ করেন না। আদেশ করেন।
তুমি ভালো করেই জানো আমি রাজ্যহারা সাধারণ একজন। আমি আমার স্ত্রীকে অবশ্যই অনুরোধ করতে পারি।
কী অনুরোধ বলুন।
তুমি কান্দাহারে ফিরে যাও। তোমার পরিচিত প্রিয়জনরা সবাই সেখানে আছেন। আমার সঙ্গে পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর কোনো অর্থ হয় না। কখন কোন বিপদ ঘটে।
হামিদা বানু কঠিন গলায় বললেন, আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। আমার মন বলছে একদিন আপনি রাজত্ব ফিরে পাবেন। দিল্লীর সিংহাসনে বসবেন। তখন আপনার সামনে আমাকে যেতে হবে কুর্নিশ করতে করতে। এই যে আমরা হাত ধরাধরি করে গাছের নিচে বসে আছি। এরকম তো হবে না। এই সুযোগ আমি ছাড়ব না। আমি সারাক্ষণ থাকব আপনার পাশে।
কে যেন পেছন দিকে এসেছে। শরীর চাদরে ঢাকা বলে তাকে চেনা যাচ্ছে না।
হুমায়ূন বললেন, কে?
আমি বৈরাম খাঁ। আমাদের এক্ষুনি রওনা হতে হবে। রাতের খাবার খাওয়ার সময় পাওয়া যাবে না।
ঘোড়া কি প্রস্তুত?
জি জাহাঁপনা।
হুমায়ূন তার স্ত্রীকে হাত ধরে তুললেন। কোমল গলায় বললেন, ক্লান্তভাবটা একটু কি কমেছে?
হামিদা বানু বললেন, হ্যাঁ কমেছে। আমরা যাচ্ছি কোথায়?
বৈরাম খাঁ জানে। আমি জানি না।
হামিদা বানু বললেন, আমি আপনার মুখ থেকে একটা শের না শুনে ঘোড়ায় উঠব না।
হুমায়ূন বললেন,
একজন প্রেমিকের কাছে চন্দ্ৰ হলো তার
প্রেমিকার মুখ।
আর জোছনা হলো প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস।
হামিদা বানু বললেন, বাহ সুন্দর শের! আপনাকে একটা কথা বলা হয় নি। আমি সন্তানসম্ভবা। আমার বিশ্রামের দিকে আপনাকে একটু নজর দিতে হবে। দিন-রাত ঘোড়ার পিঠে থাকতে পারব না।
হতভম্ব হুমায়ূন বললেন, কী বললে? হামিদা বানু হাসতে হাসতে বললেন, একবার তো লজ্জার মাথা খেয়ে বলে ফেলেছি, আর বলতে পারব না।
হুমায়ূনের বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে। জোছনা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। হুমায়ূন হামিদা বানুর পাশাপাশি যাচ্ছেন। দুজনের কারও মুখেই কোনো কথা নেই। ঘোড়া ক্লান্ত হলেও ছুটছে, তীব্ৰ গতিতে।
হামিদার গা গুলাচ্ছে। ঘোড়ার গায়ের ঘামের গন্ধ এখন আর সহ্য হচ্ছে না। তিনি কথাবার্তায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলেন। হুমায়ূনকে বললেন, আমাদের পরিকল্পনাটা কী? আমরা কি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়াব?
হুমায়ূন জবাব দিলেন না। হামিদা বানু বললেন, উদ্দেশ্যহীন পালিয়ে বেড়ানো বন্ধ করে আমাদের ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করতে হবে…
হামিদা বানুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ছোট কামানের গোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। পরপর কয়েকবার। হুমায়ূনকে ধাওয়া করা বাহিনীর কামান নিয়ে আসার কথা না। ব্যাপারটা কী?
বৈরাম খাঁ’র নির্দেশে হুমায়ূনের বাহিনী মূল পথ ছেড়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ল। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়া ঘোড়ার মতো একটি প্রাণীর পক্ষে যথেষ্ট জটিল। এই কাজটি ঘোড়ারা ভালোমতোই করছে। তারা বিপদ আঁচ করতে পারছে।
হামিদা বানু বললেন, চমৎকার বুনো ফুলের সুবাস পাচ্ছি। আপনি কি পাচ্ছেন?
হুমায়ূন বললেন, পাচ্ছি। হামিদা বানু বললেন, আমার কী সৌভাগ্য সুন্দর ফুলের ঘ্রাণ পেলাম! আল্লাহপাকের দরবারে হাজার শুকরিয়া।
মীর্জা কামরান লাহোর যাত্রা করবেন
মীর্জা কামরান লাহোর যাত্রা করবেন। জ্যোতিষী শুভক্ষণ ঠিক করে দিয়েছে। ফজরের নামাজের পরপরই যাত্রা শুরু করতে হবে। পরের শুভক্ষণ মধ্যনিশা। মীর্জা কামরান প্রথম শুভক্ষণ বেছেছেন।
কান্দাহারের রাজমহিষীরা সবাই যাবেন। কান্দাহারে থাকবেন। আসকারি মীর্জা।
যাত্রা শুরুর আগে মীর্জা কামরান তার মা গুলারুখ বেগমের কাছে গেলেন দোয়া নেওয়ার জন্যে। গুলারুখ বেগম লাহোর যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
মীর্জা কামরান মা’র কাছ থেকে বিদায় নিলেন। গুলারুখ বেগম বললেন, আমি মা হিসেবে তোমার মঙ্গল কামনা করছি। যাত্রা শুভ হোক। আমার কিছু প্রশ্ন আছে।
বলুন কী প্রশ্ন?
তুমি নাকি তোমার বড়ভাই হুমায়ূনের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰ হাতে নেবে? তাকে ধরিয়ে দেবে শের শাহ’র হাতে?
কোথায় শুনলেন এমন কথা?
গুলারুখ বেগম বললেন, দরবারের সব কথাই অন্তঃপুরে আসে। অতীতেও এসেছে, ভবিষ্যতেও আসবে। এখন আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
মীর্জা কামরান বললেন, আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। তার আগে আমার চারটি প্রশ্ন আছে। আপনাকে দীর্ঘ জবাব দিতে হবে না। দীর্ঘ জবাব শোনার মতো সময় আমার হাতে নেই। শুধু ‘হ্যা’ কিংবা ‘না’ বলবেন। প্রথম প্রশ্ন, রাজ্যহারা হুমায়ূন কি এখন বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?
হ্যাঁ।
তার সঙ্গীসাথীরা একে একে সরে পড়ছে। সৈন্যবাহিনীর প্রায় সবাই তাঁকে ত্যাগ করেছে। হ্যাঁ নাকি না?
হ্যাঁ।
তৃতীয় প্রশ্ন, রাজ্যহারা হুমায়ূনের কি এখন কোনো ভবিষ্যৎ আছে?
গুলারুখ বেগম জবাব দিলেন না। মীর্জা কামরান বললেন, আপনি জবাব দেন নি, কাজেই ধরে নিলাম। এই প্রশ্নের উত্তরও হ্যাঁ।