আপনার কি ধারণা দিল্লীর সম্রাট অশান্তিতে আছেন?
অবশ্যই। আপনারা হুমায়ূন-আতঙ্কে ভুগছেন। তাঁকে তাড়া করে ফিরছেন। আপনাদের ধারণা, তিনি দ্রুত শক্তি সংগ্ৰহ করবেন। আপনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰ হাতে নেবেন। যাই হোক আমি সরাসরি বলি, আমি আমার বড়ভাইকে জীবিত বা মৃত আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারি। তার বিনিময়ে আমি কী পাব?
বরকত খাঁ বললেন, রেশমের কাজ করা মণিমুক্তা বসানো একজোড়া পাদুকা শের শাহ নিশ্চয়ই আপনাকে দেবেন।
রসিকতা করছেন?
রসিকতা কেন করব! শের শাহ পাদুকা উপহার দিতে পছন্দ করেন। তিনি যোধপুরের রাজা মালদেবকে একজোড়া পাদুকা উপহার দিয়েছেন ৷ ঘটনার সত্যতা সন্ধান করলেই জানতে পারবেন। যাই হোক, জালাল খাঁ আমাকে পাঠিয়েছেন হুমায়ূনকে বন্দি করার বিষয়ে আপনার সাহায্য কামনা করতে। বিনিময়ে আপনি লাহোর ফিরে পাবেন। শুনেছি লাহোরের জলবায়ু আপনাকে পীড়ামুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
মীর্জা কামরান বললেন, শুধু মুখের কথা! এই বিষয়ে কোনো চুক্তি হবে না?
বরকত খাঁ বললেন, যাদের মুখের কথা মূল্যহীন তারাই চুক্তির জন্যে লালায়িত হয়। জালাল খাঁ’র মুখের কথা মূল্যহীন না।
আমি কবে লাহোর যেতে পারি?
ইচ্ছা করলে এখনই রওনা দিতে পারবেন। পান বেশি করেছেন, এই অবস্থায় রওনা দেওয়া ঠিক হবে না। বলতে ভুলে গেছি, জালাল খাঁ আপনার জন্যে উপহার পাঠিয়েছেন। উপহার। আপনার পছন্দ হবে।
কী উপহার?
বাংলা মুলুক থেকে আনা দুজন হিজড়া। হিজড়ার বিষয়ে আপনার আগ্রহের কথা আমরা জানি। শারীরিক ক্রটির কারণে ওদের অন্য গুণাবলি বিকশিত হয়। (*বঙ্গদেশের হিজড়াদের মোঘল হেরেমে কদর ছিল। রাজপুরুষরা যৌন কদৰ্যতামুক্ত ছিলেন না। ভারতবর্ষের বাইরেও তাদের চাহিদা ছিল।)
আমি উপহার পেয়ে খুশি হয়েছি, ওনাকে ধন্যবাদ।
বরকত খাঁ বললেন, আপনি আমীরদের আসরে ডাকুন। আনন্দযাত্রা অব্যাহত থাকুক। জালাল খাঁ’র উপহার কেমন তাও দেখুন। আমি বিদায় নিচ্ছি।
মীর্জা কামরানের আনন্দ ফুর্তি সারা রাত স্থায়ী হলো। হিজড়াদের নৃত্যগীত মীর্জা কামরানকে বিমোহিত করল।
কিছুক্ষণের জন্যে আমরা আচার্য হরিশংকরের কাছে ফিরে যাই। তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে হুমায়ূনের সঙ্গী হন নি। তিনি এখন আছেন পুণ্যধাম কাশিতে।
তাঁর হাতে স্বর্ণমুদ্রা এবং রৌপ্যমুদ্রার সংগ্ৰহ ভালো। হুমায়ূন তাকে দুটি রুবি পাথরও দিয়েছেন। হরিশংকরের বাকি জীবন ভালোমতোই যাওয়ার কথা।
তিনি কাশিতে একটি ঘর ভাড়া করেছেন। একজন পাচক রেখেছেন, দারোয়ান রেখেছেন। তার সময় কাটে মন্দিরে মন্দিরে।
একদিনের কথা, তিনি মন্দিরে সন্ধ্যাপূজা দেখে ঘরে ফিরে দেখেন তার বিছানায় হুমায়ূন-কন্যা আকিকা বেগম। সে হাসিমুখে বসে আছে।
হরিশংকর বুঝলেন চোখের ধাক্কা। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে রাম নাম নিয়ে চোখ খুললেন, আকিকা বেগম আগের জায়গাতেই বসা। সে মিষ্টি গলায় বলল, আমার বাবা সম্রাট হুমায়ূন কোথায়?
হরিশংকর মূৰ্ছিত হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন।
জোছনাপ্রাবিত রজনী। রাজ্যহারা সম্রাট দলবল নিয়ে পালাচ্ছেন। তিনি যাচ্ছেন সিন্ধুর দিকে। তার সারা দিন ঘোড়ার পিঠে কেটেছে। সন্ধ্যায় মাগরেবের নামাজের কিছু বিরতি নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করেছেন।
হুমায়ূনকে অনুসরণ করছেন কুতুব খাঁ। শের শাহ’র আরেক পুত্র। তার ওপর নির্দেশ হুমায়ূনকে হিন্দুস্থান-ছাড়া করতে হবে। তাঁর ওপর সরাসরি চড়াও হওয়ার প্রয়োজন নেই।
মধ্যরাতে হামিদা বানু স্বামীকে বললেন, তার বিশ্রাম প্রয়োজন। শরীর টানছে না।
হুমায়ূন সঙ্গে সঙ্গে যাত্রাবিরতির নির্দেশ দিলেন। খোলা প্রান্তর। চাঁদে আলোর ফিনকি ফুটেছে। অচেনা ঝাঁকড়া একটা গাছের নিচে চাদর পেতে বসেছেন হামিদা বানু। গাছ থেকে অনেকটা দূরে রাতের খাবারের আয়োজন হচ্ছে। খিচুড়িজাতীয় খাদ্য তৈরি হচ্ছে। রসদ ফুরিয়ে আসছে। খাদ্য তৈরিতেও সাবধানতা।
ক্লান্ত ঘোড়ার দলকে পানি এবং গম খাওয়ানো হচ্ছে। এদেরকে সুস্থ রাখা অত্যন্ত জরুরি।
হুমায়ূন একা একা হাঁটছিলেন, হঠাৎ হামিদা বানুর খিলখিল হাসির শব্দ শুনে এগিয়ে গেলেন। এই অবস্থায় এত সুন্দর করে কেউ হাসতে পারে না।
হামিদা বানু স্বামীকে দেখে গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসলেন। হুমায়ূন বিস্মিত গলায় বললেন, কী হয়েছে হামিদা?
হামিদা বললেন, কিছু হয় নি তো।
তুমি হাসছিলে।
আপনার এমন কোনো নির্দেশ আছে যে হাসা যাবে না? এই অবস্থায় কেউ আনন্দে হাসছে দেখে বিস্মিত হয়েছি। হাসার মতো কোনো কারণ কি ঘটেছে?
ঘটেছে। আপনি আমার পাশে বসুন, তারপর বলছি কী ঘটেছে।
হুমায়ূন হামিদা বানুর পাশে বসলেন। হামিদা বানু গলা নামিয়ে বললেন, আপনার হাত এগিয়ে দিন। হাত ধরে বলব।
হুমায়ূন হাত এগিয়ে দিলেন। হামিদা বানু স্বামীর হাত ধরতে-ধরতে বললেন, ভাগ্য আপনাকে অতি সাধারণ একজন মানুষের কাতারে নিয়ে এসেছে। এমন সাধারণ যে আমি ইচ্ছা করলেই এখন আপনার হাত ধরতে পারি। এই আনন্দেই হাসছি।
হুমায়ূন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। স্ত্রীর কথার উত্তরে কিছু বললেন না।
হামিদা বানু বললেন, আপনি একসময় কথায় কথায় শের বলতেন। অনেকদিন আপনার মুখ থেকে শের শুনি না। জোছনা নিয়ে কোনো শের কি আপনার জানা আছে?
না।
বিয়ের রাতে আমাকে নিয়ে যে দীর্ঘ কবিতাটি লিখেছিলেন সেটি বলুন শুনি।