মধ্যরাতে বৈরাম খাঁ সম্রাটকে ডেকে তুললেন। দুটি দুঃসংবাদ আছে, সম্রাটকে জানানো প্রয়োজন। প্রথম দুঃসংবাদ, শের শাহ লাহোরের কাছাকাছি চলে এসেছেন।
দ্বিতীয় দুঃসংবাদ, মীর্জা কামরান কিছুক্ষণ আগেই তার সেনাবাহিনী নিয়ে কান্দাহার রওনা হয়েছেন। সম্রাট হুমায়ূনের সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ সৈন্য কামরানের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তিনজন ছাড়া বাকি আমীররাও তাই করেছেন।
হুমায়ূন বললেন, বৈরাম খাঁ, এর কারণ কী?
বৈরাম খাঁ বললেন, বিচারসভায় আপনার কর্মকাণ্ড দেখা হয়েছে আপনার দুর্বলতা হিসেবে। সবাই থাকে সবলের পক্ষে।
আমি কি দুর্বল?
আপনি অনেক বেশি সবল। এটা ধরার ক্ষমতা তাদের নেই।
হুমায়ূন বললেন, সবকিছুই তিনবার করে ঘটে। সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য আসে পরপর তিনবার। তুমি আমাকে দুটি দুঃসংবাদ দিয়েছ। এখন তৃতীয়টি দাও।
বৈরাম খাঁ বললেন, সম্রাট যদি কামরান মীর্জকে মৃত্যুদণ্ড দিতেন তাহলে সেই আদেশ দ্রুত কার্যকর করার ব্যবস্থা নেওয়া ছিল। হাতি এবং হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করার জন্যে পাথর ছিল। কামরান মীর্জা সেই পাথরে সাদ মুহম্মদকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করেছেন।
সাদ মুহম্মদ কে?
সম্রাটের এবং আমার অতি অনুগত একজন। তার হাতেই কামরান মীর্জা বন্দি হয়েছিলেন।
বৈরাম খাঁ, আপনি কি নিয়তি বিশ্বাস করেন?
করি না। কিন্তু আপনি বললে করব।
সম্রাট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি বলছি না। স্বয়ং আল্লাহপাক নিয়তির কথা বলেছেন। সূরা বনি ইসরাইলে বলা আছে, আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি।
নিয়তির হাতে সম্রাট নিজেকেই সমৰ্পণ করলেন। স্ত্রী হামিদা বানু এবং অল্পকিছু অনুগতজন নিয়ে শুরু হলো তাঁর পথেপ্ৰান্তরে পালিয়ে থাকার দিন। তাকে তাড়া করে ফিরল। আরেক নিয়তির সন্তান শের খাঁ। ভুল বললাম, খাঁ না। তিনি এখন শের শাহ।
এশার নামাজ শেষ হয়েছে
এশার নামাজ শেষ হয়েছে। মীর্জা কামরান নামাজ শেষ করে নৈশকালীন মদের আসরে বসেছেন। আসরে ছয়জন আমীর উপস্থিত। তাদের হাতে রুপার পানিপাত্ৰ। মীর্জা কামরানের হাতে সোনার পানপত্র। মীর্জা কামরান ক্ষুব্ধ চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। তাঁর মেজাজ। সপ্তমে। তবে মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছেন। তার মেজাজ খারাপের প্রধান কারণ, স্বর্ণের পানিপাত্রে তাকে ছাড়াও আরেকজনকে মদ পরিবেশন করা হয়েছে। তার নাম বরকত খাঁ। বরকত খাকে কান্দাহার পাঠিয়েছেন শের শাহু-পুত্র জালাল খাঁ। বরকত খা’র মর্যাদা একজন আমীরের চেয়ে বেশি হতে পারে না। তাকে স্বৰ্ণপানপাত্রে মদ পরিবেশন করে মীর্জা কামরানকে ছোট করা হয়েছে। মীর্জা কামরান ভেবে পাচ্ছেন না, স্বৰ্ণপাত্রের এই ভুলটা কারা করেছে! খেদমতগাররা এমন বড় ভুল করবে না। নিশ্চয়ই এখানে আমীরদের ভূমিকা আছে।
বরকত খাঁ পানিপাত্রে চুমুক দিচ্ছেন না। এটিও এক ধরনের অপমান। মীর্জা কামরান বললেন, আপনার কি নেশার পানীয় বিষয়ে আসক্তি নেই?
বরকত খাঁ বললেন, জি না জনাব। আমি ধৰ্মভীরু মানুষ। ধর্মের অনুশাসন মেনে চলি। পরকালে হুররা যে মন্দিরা পরিবেশন করবেন। তার জন্যে অপেক্ষা করাটাকে উত্তম মনে করি।
মীর্জা কামরান বললেন, আপনি কি জালাল খাঁ’র কাছ থেকে কোনো পত্র এনেছেন?
জি না জনাব। জালাল খাঁ তার পিতার স্বভাব পেয়েছেন। কলমের খেলার চেয়ে অসির খেলা তার অধিক পছন্দ।
মীর্জা কামরান পানপাত্রে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে বললেন, জালাল খাঁ আপনাকে পাঠিয়েছেন কেন?
আপনার কুশল জানার জন্যে। আপনার শরীর কেমন জনাব?
শরীর ভালো।
পেটের পীড়ার ঘনঘন আক্রমণে শিকার হন বলে শুনেছি। পেট কি ঠিক আছে?
পেট ঠিক না থাকলে আপনি কি ওষুধ দেবেন?
সেই যোগ্যতা আমার নাই জনাব। আমি সামান্য দূত। কথা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার বাহনবিশেষ।
মীর্জা কামরান বললেন, জালাল খাঁ’র কাছ থেকে কী কথা এনেছেন বলুন শুনি।
আমি কথা এনেছি আপনার জন্যে। আপনার আমীরদের জন্যে না। তাদের সামনে আমি মুখ খুলব না।
ওরা সবাই আমার বিশ্বস্ত।
বরকত খাঁ হাসতে হাসতে বললেন, এদের মধ্যে অনেকেই কিছুদিন আগে হুমায়ূনের বিশ্বস্ত ছিলেন। আমীরদের বিশ্বস্ততা আর বেশ্যাপল্লীর বেশ্যাদের শারীরিক পবিত্রতা তুল্যমূল্য।
মীর্জা কামরান কঠিন ভাষায় বললেন, আপনি আমার সামনে আমার আমীরদের অপমান করছেন!
দুঃসময়ে কোনো অপমান গায়ে মাখতে হয় না। মোঘলদের এখন চরম দুঃসময়।
মীর্যা কামরান বললেন, আপনার যদি কিছু বলার থাকে আমার আমীরদের সামনেই বলতে হবে।
বরকত খাঁ বললেন, আমার কিছুই বলার নাই জনাব। কুশল জানতে এসেছিলাম। কুশল জানা হয়েছে। সন্তোষ লাভ করেছি। এখন অনুমতি পেলে বিদায় হব।
বলতে-বলতে বরকত খাঁ উঠে দাঁড়ালেন। লোকটির ঔদ্ধত্য এবং দুঃসাহস দেখে মীর্জা কামরানের পিত্তি জ্বলে গেল। প্রধান আমীর বললেন, আমরা চলে যাচ্ছি। আপনারা আলোচনায় বসুন। সবার শান্তির জন্যেই আলোচনা জরুরি।
মীর্জা কামরান ইশারায় বরকত খাঁকে বসতে বললেন। আমীররা ঘর খালি করে চলে গেল। দুজন খিদমতগারকেও চলে যেতে হলো।
বরকত খাঁ বললেন, এখন মূল কথায় আসা যাক। জালাল খাঁ আপনার কাছে জানতে চাচ্ছেন, আপনি শের শাহ’র জন্যে অর্থাৎ দিল্লীর মহান সম্রাটের জন্যে কী করতে পারেন।
মীর্জা কামরান বললেন, আমাকে শান্তিতে থাকতে দিলে অনেক কিছুই করতে পারি। আপনারা আমাকে শান্তি দেবেন, আমি আপনাদের শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করব।