কামরান মীর্জাকে বন্দি করা হয়েছে—এই খবর অন্তঃপুরের রাজমহিষীরা জেনেছেন। কামরান মীর্জার মা গুলারুখ বেগম আতঙ্কে অস্থির। তিনি জানেন তাঁর ছেলেকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের এই শাস্তির বিধান। মা হয়ে সন্তানের মৃত্যু তিনি নিতে পারছেন না। তিনি কিছুক্ষণ পরপর জ্ঞান হারাচ্ছেন। দুপুরের দিকে খবর পাওয়া গেল সম্রাট হুমায়ূন এসেছেন, গুলারুখ বেগমের সঙ্গে দেখা করতে। গুলারুখ বেগমের উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ছিল না। দুজন দাসী তাকে ধরাধরি করে সম্রাটের সামনে উপস্থিত করল।
হুমায়ূন বললেন, মা! আপনি নিশ্চয়ই কামরান মীর্জার কর্মকাণ্ড বিষয়ে অবগত হয়েছেন?
গুলারুখ বেগম হাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
হুমায়ূন বললেন, আপনার কি কামরান মীর্জার বিষয়ে কিছু বলার আছে? বাদ আসার তার বিচার বসবে।
গুলারুখ বেগম বললেন, অপরাধী অপরাধের জন্য শাস্তি পাবে। আমার বলার কিছু নেই।
আপনার করুণ অবস্থা দেখে আমি ব্যথিত। আমি দুপুরে আমার সঙ্গে খাবার গ্রহণের জন্য আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনি কি আমার সঙ্গে খাবার গ্রহণ করবেন?
না।
হুমায়ূন বললেন, আল্লাহ্পাক আপনার মনের কষ্ট দূর করুক। আমিন।
কামরান মীর্জকে রাখা হয়েছে সাধারণ একটি তাঁবুর ভেতরে। তাঁর দুই হাত পেছন দিকে শক্ত করে বাধা। তাঁকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁবুর চারদিকে বৈরাম খাঁ’র অনুগত একদল ঘোড়সওয়ার সৈন্য। এদের নেতৃত্বে আছে সাদ মুহম্মদ। সে কামরানের সঙ্গে তাঁবুর ভেতর আছে।
কামরান মীর্জা বললেন, তোমার নাম কী?
সাদ মুহম্মদ।
কামরান বললেন, এটা আবার কেমন নাম! আমি তোমার নাম দিলাম। বাদ মুহম্মদ।
আপনার অভিরুচি।
আমার বাঁধন খুলে দাও। আমি জোহরের নামাজ আদায় করব।
বিশেষ বিশেষ অবস্থায় ইশারায় নামাজ পড়ার বিধান আছে। আপনার এখন সেই অবস্থা।
আমি ক্ষুধার্ত। আমার জন্যে দুপুরের খাবারের কী ব্যবস্থা?
সাদ মুহম্মদ জবাব দিল না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল।
কামরান বললেন, তুমি ব্যাঙাচির কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে আসো, আমাকে দুপুরের খাবার দেওয়া হবে কি না।
কাকে ব্যাঙচি বলছেন?
বৈরাম খাঁকে। ব্যাঙচি তার যথার্থ পরিচয়।
আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার হুকুম নেই।
সম্রাটের সামনে আমাকে কখন হাজির করা হবে?
জানি না। শুনেছি আসরের পর।
আমি আমার ভাইকে চিনি। আমার ভাই যখন শুনবেন আমাকে না। খাইয়ে রাখা হয়েছে তিনি রাগ করবেন। তুমি যাও, আমার খাবারের ব্যবস্থা করো।
আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্যে হাতি এবং পাথর প্রস্তুত করা হয়েছে। আমার উপদেশ, আপনি আহারের কথা চিন্তা না করে আসন্ন মৃত্যুর কথা চিন্তা করুন। এবং আল্লাহপাকের নাম নিতে থাকুন।
আমি তৃষ্ণার্তা। পানি খাব।
আপনার সামনে থেকে উঠে যাওয়ার হুকুম আমার নেই।
বাদ মুহম্মদ, তোর ধৃষ্টতা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার মনে থাকবে।
হুমায়ূন আচার্য হরিশংকরকে ডাকে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর সঙ্গে দুপুরের খাদ্য গ্ৰহণ করবেন। হরিশংকর নিরামিশাষী। তাঁর জন্যে ত্রিশ পদের নিরামিষের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি ছোওয়া বাঁচিয়ে রেশমের আসনে আলাদা বসেছেন।
সম্রাট বললেন, আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।
হরিশংকর বললেন, আমার জীবন আমি আপনাকে নিবেদন করেছি। কাজেই আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার কিছু নেই।
আপনি কীভাবে জানলেন, কামরান মীর্জা শের শাহ’র কাছে পত্র পাঠিয়েছে?
সম্রাটের স্বার্থেই আমি কামরান মীর্জার আস্থাভাজন হয়েছি। আমি এই পত্রের বিষয়ে সরাসরি তার কাছ থেকে জানতে পারি।
আপনি একজনের বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন।
আমি যা করেছি সম্রাটের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে করেছি। সম্রাটের জন্যে যদি আরও হাজারজনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হয়, আমি করব।
আপনি খাদ্য গ্রহণ করছেন না। খাবার নাড়াচাড়া করছেন। কারণ জানতে পারি?
আমি একটি বিষয় নিয়ে কঠিন উদ্বেগের মধ্যে আছি বলেই আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা লোপ পেয়েছে।
উদ্বেগের কারণ জানতে পারি?
শের শাহ বিশাল বাহিনী নিয়ে লাহোরের দিকে ছুটে আসছেন। এই বিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করা এই মুহুর্তে সম্রাটের পক্ষে সম্ভব না।
এমন পরিস্থিতিতে আপনার পরামর্শ কী?
আমি অতি ক্ষুদ্র একজন। সম্রাটকে পরামর্শ দেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। তারপরও বলব সম্রাট যেন কান্দাহারের দিকে চলে যান।
পালিয়ে যেতে বলছেন?
হ্যাঁ। য পলায়তি স্ব জীবতি।
এর অর্থ কী?
এর অর্থ, যে পলায়ন করে সে বেঁচে থাকে।
মীর্জা কামরানকে সম্রাটের সামনে উপস্থিত করা হয়েছে। তাঁর কোমরের তরবারি গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই হাত শক্ত করে পেছন দিকে বাঁধা। সম্রাটের সামনে বন্দিদের এইভাবেই উপস্থিত করানোর রীতি।
কামরান কুর্নিশ করার চেষ্টায় সামান্য নিচু হলেন।
হুমায়ূন বললেন, আমার ভাইকে কেন তোমরা এভাবে আমার সামনে উপস্থিত করেছ? এক্ষুনি হাতের বাঁধন খুলে দাও। গলা থেকে তরবারি নামাও।
তা-ই করা হলো। সম্রাট উঠে এসে ভাইকে আলিঙ্গন করলেন। সম্রাট বললেন, আমার মহান পিতা মৃত্যুর আগে আমাকে বলেছেন, তুমি সবসময় ভাইদের দেখবে ক্ষমাসুন্দর চোখে। আমি তা-ই করছি। ভাই কামরান, এসো তুমি আমার ডানপাশে এসে বসো।
কামরান মীর্জা তা-ই করলেন। অসময়ের একটি তরমুজ এসেছিল। খোরাসান থেকে। সম্রাট নিজের হাতে সেই তরমুজের খণ্ড ভাইয়ের মুখে তুলে দিলেন। এমন আবেগঘন মুহূর্তে দরবারে ‘মারহাবা’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়। কেউ মারহাবা ধ্বনি দিল না। সম্রাট ভাইকে বিশ্রাম নিতে পাঠালেন।