স্বপ্নে তিনি তাঁর পিতা বাবরকে দেখেছেন। পাদশাহ বাবর ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছেন। পেছনে পেছনে যাচ্ছেন হুমায়ূন। জায়গাটা মনে হলো কাশ্মীরের কোনো বাগান। কাশ্মীর পাদশাহ বাবরের অতি প্রিয় স্থান। কাশ্মীরকে তিনি বলতেন, আমার ব্যক্তিগত বাগিচা।
ঘোড়ায় যেতে যেতে একটা জলা জায়গার কাছে বাবর থামলেন। ঘোড়া থেকে নামলেন না। হুমায়ূনকে বললেন, তাকিয়ে দেখো কী সুন্দর জলপদ্ম! যাও এই পদ্মটি তুলে আনো। আমি এত সুন্দর জলপদ্ম কখনো দেখি নি।
পিতার আদেশ শুনে হুমায়ূন ঘোড়া থেকে নামলেন। পদ্ম আনতে তাকে পানিতে পা ফেলতে হলো। পানি বরফশীতল। কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ।
স্বপ্নের এই পর্যায়ে সম্রাটের ঘুম ভাঙল। অনেকদিন তিনি পিতাকে স্বপ্নে দেখেন না। তাঁর চেহারাও হুমায়ূনের কাছে অস্পষ্ট হয়ে আসছিল। স্বপ্নে পিতাকে অতি স্পষ্ট দেখে হুমায়ূনের মন আনন্দে পূর্ণ হয়েছে। তিনি নিশ্চিত এটি একটি ভালো স্বপ্ন।
লাহোরের এই বাগানে জলপুষ্প ফোটার জন্যে একটি জলাধার করা হয়েছে। সম্রাট হুমায়ূন জলাধারের দিকে যাচ্ছেন। তাঁর মন বলছে জলাধারে তিনি জলপদ্ম ফুটে আছে দেখবেন।
খুব কাছ থেকে কেউ একজন বলল, আমি কি সম্রাটের সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকতে পারি? অতি জরুরি কিছু কথা আমার সম্রাটকে বলা দরকার।
সম্রাট ঘাড় ফিরিয়ে বৈরাম খাঁকে দেখলেন। বৈরাম খাঁকে চিন্তিত এবং বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। হুমায়ূন বললেন, আপনার সঙ্গ আমার সবসময় প্রিয়। আসুন আমরা দুজন জলপদ্মের সন্ধানে যাই। জরুরি। আলাপের জন্য সময় অনেক পাওয়া যাবে।
বৈরাম খাঁ এগিয়ে এলেন। হুমায়ূন বললেন, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে বিনিদ্র রজনী কেটেছে। বলুন জরুরি কথা।
আমি একটি পত্র নিয়ে এসেছি।
হুমায়ূন বললেন, পত্র কে পাঠিয়েছে? শের শাহ?
না, পত্রটি লেখা হয়েছে শের শাহকে। লিখেছেন আপনার ভ্রাতা মীর্জা কামরান।
হুমায়ূন জলাধারের দিকে যাচ্ছিলেন, বৈরাম খাঁর কথায় তার থমকে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা। তিনি থমকে দাঁড়ালেন না। জলাধার পর্যন্ত গেলেন। সেখানেও জলপদ্ম ফুটেছে। স্বপ্নের মতো সুন্দর না হলেও সুন্দর। একসঙ্গে অনেকগুলি ফুটেছে বলেই সুন্দর। স্বপ্নে একটা জলপদ্মই ছিল। হুমায়ূন আনন্দিত গলায় বললেন, বাহ্!
বৈরাম খাঁ বললেন, পত্রটা কি এখন পড়বেন?
হুমায়ূন বললেন, এই অপূর্ব দৃশ্য কিছুক্ষণ দেখতে দিন, তারপর পত্র পাঠ করব।
দীর্ঘনিঃশ্বাস চাপতে চাপতে বৈরাম খাঁ বললেন, অবশ্যই। আপনি দৃশ্য দেখুন।
শের শাহকে লেখা মীর্জা কামরানের পত্র—
দিল্লীর মহান সম্রাট, জগৎ স্বীকৃত বীরপুরুষ মহানুভব শের শাহ।
আমি দীর্ঘ পত্রালাপে যাচ্ছি না। আমার ভাই হুমায়ূন মীর্জা এই বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী। মূল কথায় যাই। আমি আমার ভাইকে বন্দি করে আপনার হাতে তুলে দিতে রাজি আছি। বিনিময়ে আমি কী পাব তা দূত মারফত জানালে খুশি হব।
ইতি
আপনার অনুগত
মীর্জা কামরান
হুমায়ূন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে আবারও জলাধারভর্তি পদ্মের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, বৈরাম খাঁ, আপনি কি এই ফুলগুলির আয়ু জানেন?
বৈরাম খাঁ বললেন, আমি সৈনিক মানুষ। আমার চিন্তা আমার মহান সম্রাটের এবং আমার সৈন্যদের আয়ু নিয়ে।
হুমায়ূন বললেন, অপূর্ব এই ফুল মধ্যরাতে ফোটে এবং মধ্যদুপুরে বুজে যায়। সাত দিন এরকম চলে, তারপর এর আয়ু ফুরায়।
সম্রাট, আমরা কি মূল বিষয়ে আসতে পারি?
মূল বিষয়ে যেতে মন চাচ্ছে না বলেই পুষ্প বিষয়ে কথা।
অবস্থা যে গুরুতর তা কি বুঝতে পারছেন?
পারছি।
আপনার কি মনে হয় না। এই মুহূর্তেই কামরান মীর্জাকে বন্দি করা প্রয়োজন?
তা কি সম্ভব?
বৈরাম খাঁ বললেন, গত রাতে শেষ প্রহরে আমি তাকে বন্দি করেছি। আপনার হুকুম পাওয়ামাত্র তাকে আপনার সামনে উপস্থিত করা হবে।
সম্রাট বললেন, শাবাশ।
বৈরাম খাঁ মাথা নিচু করে প্রশংসা গ্রহণ করলেন। হুমায়ূন বললেন, কেউ চমৎকার কোনো কাজ করলে আমরা বলি শাবাশ। কেন বলি জানেন?
না।
পারস্য-সম্রাট শাহ আব্বাসের কারণে বলি। শাহ আব্বাস সারা জীবন প্রশংসনীয় সব কাজকর্ম করে গেছেন। সেখান থেকেই শাবাশ শব্দটি এসেছে।
বৈরাম খাঁ বললেন, আমি সৈনিক মানুষ। এত কিছু আমার জানার প্রয়োজন নাই। যুদ্ধবিদ্যা জানা প্রয়োজন। তারপরেও সম্রাটের কাছ থেকে শিক্ষামূলক প্রতিটি বিষয় আমি মনে রাখি। এখন অধীনের আপনার প্রতি দুটি বিশেষ অনুরোধ আছে।
আপনার যে-কোনো অনুরোধ রাখা হবে। অন্যায় অনুরোধ হলেও আমি রাখব। বলুন কী অনুরোধ?
আমার দুটি অনুরোধ-কামরান মীর্জাকে বিদ্রোহ এবং গোপন ষড়যন্ত্রের শান্তি মৃত্যুদণ্ড দেবেন। এবং এই দণ্ডাদেশ আজ সূর্যাস্তের আগেই কার্যকর করবেন।
দ্বিতীয় অনুরোধ কী?
যার কারণে আমরা এই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে জানতে পারি তাকে পুরস্কৃত করবেন।
সে কে?
তার নাম হরিশংকর।
হরিশংকরকে পুরস্কৃত করা হবে। তাঁকে আমার সামনে উপস্থিত করুন।
কামরান মীর্জাকে কখন উপস্থিত করব?
আসরের নামাজের পর। বৈরাম খাঁ বললেন, আমি কি আশা করতে পারি, মাগরেবের নামাজের আগেই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে?
হুমায়ূন জবাব দিলেন না।
বৈরাম খাঁ বললেন, হাতির পায়ের নিচে মস্তক পিষ্ট করে মৃত্যুই হলো এমন অপরাধীর নিম্নতম শাস্তি।
হুমায়ূন এবারও কিছু বললেন না।
আমি শাস্তির ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করে রাখব। আপনার আদেশ পাওয়ামাত্র শাস্তি কার্যকর হবে।