আপনি কি আমার উজিরদের একজন হতে রাজি আছেন?
না।
না কেন?
যতদিন সম্রাট জীবিত ততদিনই আমি সম্রাটের অনুগত নফর। কোনো কারণে সম্রাটের প্রাণহানি হলে আমি আপনার প্রস্তাব বিবেচনা করব। তার আগে না।
আছরের নামাজের পরপর মীর্জা কামরান বিছানা ছেড়ে উঠলেন। ঘোষণা করলেন, আল্লাহপাকের অসীম করুণায় তিনি রোগমুক্ত হয়েছেন। তিনি রোগমুক্তি-স্নান করে মাগরেবের নামাজ আদায় করার প্রস্তুতি নিলেন। রোগমুক্তি উপলক্ষে রাজমহিষীরা সবাই উপহার পেলেন। যারা গৃহবন্দি ছিলেন, তাদের বন্দিদশা দূর হলো। সর্ব সাধারণের কাছে গেল। তিন হাজার রৌপ্য মুদ্রা। আমীররা খেলাত পেলেন। আচার্য হরিশংকরকে দেওয়া হলো রত্নখচিত ভোজালি।
কনৌজের যুদ্ধ
কনৌজের যুদ্ধে হুমায়ূনের শোচনীয় পরাজয় হলো। চৌসার যুদ্ধে তিনি যেসব ভুল করেছিলেন এই যুদ্ধেও সেইসব ভুল করলেন। কামানচির দল কামানের একটি গোলাও ছুঁড়তে পারল না।
হুমায়ূনের ছত্রভঙ্গ বাহিনীর একটা বড় অংশ গঙ্গার পানিতে ড়ুবে মরল। যারা বেঁচে রইল তাদের তাড়া করল শের শাহ’র বড় পুত্র জালাল খাঁ।
চৌসার যুদ্ধে হুমায়ূন গঙ্গার পানিতে পড়েছিলেন। এবারও তাই হলো। তিনি হাতি নিয়ে গঙ্গায় পড়লেন। হাতি তাঁকে নিয়ে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। শের শাহ’র তীরন্দাজ বাহিনী ধনুক উঁচিয়ে আছে। ইচ্ছা করলেই তীর ছুড়ে তারা সম্রাটকে মারতে পারে। তারা এই কাজটি করছে না। কারণ শের শাহ’র কঠিন নির্দেশ-হুমায়ূনকে হত্যা বা আহত করা যাবে না। তাকে বন্দি করাও যাবে না। তাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
জালাল খাঁ পরাজিত সৈন্যদের ধাওয়া করে দিল্লী পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। পনেরই জুলাই ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ দিল্লীর সিংহাসন দখল করে বসলেন।
ওই দিন প্রবল বর্ষণ হলো। দীর্ঘদিন দাবাদাহে অতিষ্ঠ দিল্লীবাসীদের আনন্দের সীমা রইল না। তারা বৃষ্টিতে ভেজার জন্যে পথে নেমে পড়ল। তারা লক্ষ্য করল, অতি সাধারণ চেহারার এক ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে দিল্লীর পথে নেমে বৃষ্টিতে ভিজছে। এই ব্যক্তি দিল্লীর সিংহাসন দখল করে নিয়েছে। জনতার কেউ তা বুঝতে পারল না।
হুমায়ূন লাহোর থেকে শের শাহকে একটি কবিতা লিখে পাঠালেন। কবিতাটি হলো–
দর আইনা গরচে খুদ নুমাই বাশদ
পৈবস্তা জ খেশতান জুদাই বাশদ।
খুদ রা বা মিশলে গোর দীদন অজব অস্ত;
ঈ বুলি অজবো কারে খুদাই বাশদ। (গুলবদন, হুমায়ূননামা।)
[যদিও আয়নায় নিজ চেহারা দেখা যায় তারপরেও তা আলাদা থাকে। নিজেকে অন্যরূপে দেখা বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার। এ হলো আল্লাহর অলৌকিক কাজ।]
শের শাহ চিঠির জবাবে লিখলেন, আমি মূর্খ বিশেষ। আপনার কবিতার অর্থ বোঝা আমার জ্ঞানের অতীত। আমি লাহোর দখল করতে রওনা হব। আপনার জন্যে লাহোর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মঙ্গল হবে।
মীর্জা হিন্দালের মা
মীর্জা হিন্দালের মা দিলদার বেগমের দিনলিপি। শ্রুতিলিখন করেছে তার এক দাসী হোসনা জান।
আমার রাতের ঘুম এবং এবাদত হারাম হয়ে গেছে। আমি চোখের পাতা বন্ধ করলেই দস্যু শের শাহকে স্বপ্নে দেখি। এই দাসু তার পঙ্গপাল বাহিনী নিয়ে ছুটে আসছে। তার একমাত্র ইচ্ছা মোগল বংশকে সমুলে ধ্বংস করা। হুমায়ূন তার হাতে ধরা পড়লে না জানি কী পরিণতি হবে। মনে হয় সে আমার অতি আদরের হুমায়ূনকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করবে। শুনেছি। দস্যুটা মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে পছন্দ করে, আল্লাহপাকের কাছে আমার প্রার্থনা—যেন কোনো ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে দস্যু তার দলবল নিয়ে মৃত্যুবরণ করে।
দিনলিপিতে যে অস্থিরতা দিলদার বেগম দেখালেন তার চেয়ে অনেক বেশি অস্থির সম্রাট হুমায়ূন। তিনি তাঁর দিনলিপি লেখা বন্ধ রেখেছেন। সৈন্য সংগ্রহের মতো অর্থের জোগাড় করতে পারছেন না। প্রতিটি মিত্র রাজার কাছে চড়া সুদে অর্থ চেয়ে পত্র লিখেছেন। কেউ পত্রের জবাব দেওয়ার সৌজন্যও দেখাচ্ছে না। তারা এখন এমন কিছুই করবে না যাতে দিল্লীর অধীশ্বর শের শাহ বিরক্ত হন।
হুমায়ূনের ব্যক্তিগত ঘোড়সওয়ার বাহিনীর একটি অংশ কামরান মীর্জার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। কামরান মীর্জা তাতে আপত্তি করে নি কেন? সে কি হুমায়ূনকে ত্যাগ করে শের শাহ’র সঙ্গে যুক্ত হবে? এও কি সম্ভব?
কামরান মীর্জা আমীরদের নিয়ে ঘনঘন দরবার করছে। এর কোনোটাতেই হুমায়ূনকে ডাকা হচ্ছে না।
সম্রাটের কাছে খবর আছে, গভীর রাতে কামরানের এক আমীর ফতে খাঁ লাহোর ত্যাগ করেছে। তার সঙ্গে বারোজন সৈন্যের একটা দল আছে। এই আমীর কি কামরানের গোপন কোনো চিঠি নিয়ে শের শাহ’র কাছে গেছে?
হুমায়ূন সব ভাইদের এক করার জন্যে একটি আলোচনা-সভা ডেকেছিলেন। সেই সভায় তাঁর সব ভাইরা উপস্থিত থাকলেও কামরান আসে নি।
বড় অস্থির সেই সময়ে দিলদার বেগম হুমায়ূনকে গোপন এক পত্র পাঠালেন। সেখানে লেখা–
পুত্ৰসম হুমায়ূন
সম্রাট
বাদশাহ নামদার। তুমি নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়েছ বলে শুনেছি। এই মুহুর্তে তোমার অর্থের অবশ্যই প্রয়োজন। আমার কাছে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং দুই লক্ষ রৌপ্যমুদ্রা গোপনে রাখা আছে। তুমি আমার কাছ থেকে এই অর্থ সংগ্রহ করে কাজে লাগাও। তোমার চন্দ্রের মতো মুখমণ্ডল অনেকদিন দেখি না।
ইতি
দিলদার বেগম
হুমায়ূন দিলদার বেগমের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। হুমায়ূনের সঙ্গে তার চার পত্নী। পত্নীরা হলেন–
বেগা বেগম
মাহ চুচক বেগম
গুনবার বেগম
মেওয়াজান