বাবর বললেন, সম্রাটের কোনো পুত্র থাকে না। স্ত্রী থাকে না। আত্মীয়-পরিজন থাকে না। সম্রাটের থাকে তরবারি।
আপনার থাকে। কারণ আপনি অন্য সম্রাটদের মতো না। আপনি আলাদা।
আমি প্রধান উজির মীর খলিফার সঙ্গে পরামর্শ করেছি। প্রধান উজির হুমায়ূন মীর্জাকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার পক্ষে। কঠিন শাস্তি দেওয়া হলে তার ভাইরা সাবধান হবে। অন্য রাজপুরুষরাও সাবধান হবে।
মাহিম বেগম চুপ করে রইলেন। বাবর বললেন, প্রধান উজির হুমায়ূন মীর্জার মৃত্যুদণ্ড শাস্তির পক্ষে। হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে মৃত্যু।
মাহিম বেগম বললেন, প্রধান উজির কী বলছেন তা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। আপনি কী ভাবছেন তা গুরুত্বপূর্ণ।
বাবর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। অদ্ভুত এই হাসি দেখে হঠাৎ মাহিম বেগমের গায়ে কাটা দিয়ে উঠল।
হুমায়ূন মীর্জা বাদাখশানের পথে। এখন যাত্রাবিরতি। রাজকীয় তাঁবু ফেলা হয়েছে। তিনি গরমে অতিষ্ঠ। স্নানের বাসনা প্রকাশ করেছেন। স্নানপাত্রে পানি ঢালা হচ্ছে। গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো হচ্ছে। আট ভাগ পানির সঙ্গে এক ভাগ গোলাপের পাপড়ি মেশানো হবে। পানিতে সামান্য কপূরও দেওয়া হবে। কপূর মেশানো পানিতে দৈত্যাকৃতি পাখা দিয়ে হাওয়া দেওয়া হবে। এই হাওয়ায় কপূর উড়ে গিয়ে পানি দ্রুত শীতল হবে।
হুমায়ূন মীর্জার হাতে রঙতুলি এবং চীন দেশ থেকে আনা শক্ত তুলট কাগজ। তিনি আগ্রহ নিয়ে একটা পাখির ছবি আঁকছেন। পাখির পালক ঘন নীল। ঠোঁট এবং পা লাল। পাখিটা মনের আনন্দে তার তাবুর পাশেই ঘুরছে। জনসমাগম দেখে ভয় পাচ্ছে না। কেউ এর নাম-পরিচয় বলতে পারছে না। হুমায়ূন মীর্জার সার্বক্ষণিক সঙ্গী দু’জন চিত্রকর এবং একজন হরবোলা পাখির পরিচয় বের করার চেষ্টায় আছে। চিত্রকরদের একজন হুমায়ূন মীর্জার ভ্ৰাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে পাখি-বিষয়ক বই নিয়ে এসে পাতা ওল্টাচ্ছেন। অন্যজন হুমায়ূন মীর্জার মতোই পাখির ছবি আঁকছেন। যেন পরে ছবি দেখে পাখির পরিচয় পাওয়া যায়। হরবোলা অপেক্ষা করছে। কখন পাখি ডেকে ওঠে। একবার ডাকলেই হরবোলা বাকি জীবন এই ডাক মনে করে রাখবে। পাখি এখনো ডাকছে না।
রাত অনেক হয়েছে।
সম্রাট বাবর ঘুমাবার প্রস্তুতি নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকেছেন। ইয়েমেন থেকে আনা হালকা সৌরভের আগরবাতি জ্বলছে। হাবশি খোজারা টানাপাখা টানছে। বড় বড় মাটির পাত্রে পানি রাখা আছে। তাদের গায়ে বাতাস পড়ায় ঘর শীতল। হিন্দুস্থানের অতি গরম আবহাওয়া বাবর এখনো সহ্য করে উঠতে পারেন নি। গরমের রাতগুলিতে প্রায়ই তাকে অয়ুম কাটাতে হয়।
মাহিম বেগম ঘরে ঢুকে সম্রাটকে কুর্নিশ করলেন। সম্রাট স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না। আল্লাহর ইচ্ছায় আমি তোমাকে একটা সুসংবাদ দিচ্ছি। রাজকোষ লুণ্ঠনের অপরাধে তােমার পুত্রের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলাম। তাকে ধরে আনার জন্যে আমার বিশাল সেনাবাহিনী আগামীকাল প্রত্যুষে যাত্রা করার কথা। কিছুক্ষণ আগে আমি তোমার পুত্রকে ক্ষমা করেছি।
মাহিম বেগম কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, সম্রাট যদি অনুমতি দেন। তাহলে আমি সম্রাটের পায়ে চুম্বন করতে আগ্রহী।
অনুমতি দিলাম।
মাহিম বেগম সম্রাটের পায়ে মুখ ঘষতে লাগলেন। সম্রাট সামান্য চমকালেন। এই দৃশ্যের সঙ্গে কি তাঁর দুঃস্বপ্নের কোনো মিল আছে? স্বপ্নে একটা পঙ্গু ভেড়া এই ভঙ্গিতেই তার পায়ে মুখ ঘষছিল। মাহিম বেগম তার অতি আদরের স্ত্রী। হুমায়ূন মীর্জার মাতা।
মাহিম বেগম বললেন, কাবুলের দুর্গে হুমায়ূন মীর্জার জন্ম হয়। তাকে দেখতে এসে আপনি খুশি হয়ে আমাকে এক শ’ আশরাফি উপহার দেন। তখন আমি আপনাকে কী বলেছিলাম। আপনার কি মনে আছে?
সম্রাট ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মনে আছে। তুমি বলেছিলে স্বর্ণমুদ্রার আমার প্রয়োজন নাই। আপনি শুধু পুত্রের গায়ে হাত রেখে বলবেন, আপনি তার উপর কখনো রুষ্ট হবেন না। শোনো মাহিম বেগম, আমি সেই প্রতিজ্ঞা কিন্তু করি নাই। যাই হোক অনেকক্ষণ পায়ে মাথা রেখেছ। এখন মাথা তোল।
মাহিম বেগম বললেন, আপনার কিছু বিষয় আমি বুঝি না। আপনার পরম শত্রু ইব্রাহিম লোদী পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত এবং নিহত। এই ইব্রাহিম লোদীর মা’কে আপনি রাজ-অন্তঃপুরে স্থান দিয়েছেন। কারণ জানতে পারি?
পার। এই মহিলা কোনো অপরাধ করেন নি। নিহত পুত্রের চেহারা দেখে শোকে অধীর হয়েছেন। আমি তার প্রতি দয়া করব না!
আপনি অবশ্যই করবেন। আপনাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করাই আমার অন্যায় হয়েছে।
(ইব্রাহিম লোদীর মা প্রথম সুযোগেই বাবরকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা করেন। তাঁর এই অপরাধও ক্ষমা করা হয়।)
৪র্থ জিল্কদ্ ৯১৩ হিজরির (ইংরেজি ৬ মার্চ, ১৫০৮ খ্রিষ্টাব্দ) মঙ্গলবার রাতে নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ূন মীর্জা জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতার দিক থেকে তৈমুরের পঞ্চম অধস্তন এবং মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের পঞ্চদশ পুরুষ।
নাসিরুদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ূন মীর্জা নামের আবজাদ (আরবি অক্ষর থেকে নামের সংখ্যা মান বের করা। অনেকটা নিউমারোলজির মতো।)
আমি বাদশাহ নামদার গ্রন্থে ৯১৩ আবজাদ সংখ্যায় সম্রাট হুমায়ূনের বিচিত্ৰ কাহিনী বর্ণনা করব। এই কাহিনীতে ঔপন্যাসিকের রঙ চড়ানোর কিছু নেই। সম্রাট হুমায়ূন অতি বিচিত্র মানুষ। ভাগ্য বিচিত্র মানুষ নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। ভাগ্য তাকে নিয়ে অদ্ভুত সব খেলা খেলেছে।