তিনি চোখ বন্ধ করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে লাগলেন। শের শাহ্কে অতি দ্রুত পরাজিত করতে হবে। তিনি কি ভাইদের সাহায্য পাবেন? অবশ্যই পাবেন। ভাইদের প্রতি স্নেহ এবং মমতার কোনো অভাব তিনি দেখান নি। সাধারণ নিয়মে সিংহাসনে বসার পরপর ভাইদের হত্যা করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে কেউ বিদ্রোহ করতে না পারে। তিনি তা করেন নি। তিনি পিতার আদেশ মনে রেখেছেন।
মৃত্যুর আগে সম্রাট বাবর পুত্র হুমায়ূন মীর্জার হাত ধরে বলেছিলেন, আমার মন বলছে তোমার ভাইরা তোমাকে অনেক যন্ত্রণা দেবে, তারপরেও তুমি তাদের প্রতি কোমল থাকবে। যে ভাইদের প্রতি কোমল থাকে, আল্লাহপাক তার প্রতি কোমল থাকেন। নৌকার মাঝির কথায় তার চিন্তা বাধাগ্ৰস্ত হলো।
নৌকার মাঝি বলল, হুজুর, বিশাল একটা নৌকা আমাদের পিছনে পিছনে আসছে। আমাদের থামতে ইশারা করছে। আমরা কি থামাব?
হুমায়ূন শুয়ে রইলেন। জবাব দিলেন না। তার কাছে কোনো জবাব নেই।
নৌকার মাঝি বলল, ওই নৌকায় সৈন্য আছে। আমরা না থামলে বিরাট সমস্যা হবে।
শের শাহ’র সৈন্য?
মাঝি বলল, সে রকমই অনুমান করি। চারদিকেই এখন শের শাহ’র সৈন্য।
হুমায়ূন বললেন, ছোট কোনো খালে নৌকা ঢুকিয়ে দিতে পার?
পারি। তাতে লাভ হবে না। আমরা ওদের নজরের মধ্যে আছি। খালে নৌকা ঢোকালে ওরাও খালে ঢুকবে।
হুমায়ূন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
হুজুর! ওরা খুব কাছে চলে এসেছে।
হুমায়ূন হতাশ গলায় বললেন, আসুক। আর তখনই শুনলেন ওই নৌকা থেকে কে একজন বলছে—হিন্দুস্থানের মহান সম্রাট হুমায়ূন কি নৌকায় আছেন?
কণ্ঠস্বর হুমায়ূনের পরিচিত। অবিকল বৈরাম খাঁ’র গলা। প্রচণ্ড মানসিক চাপে মানুষের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়, তখন সে নানান ধরনের ভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। তার বেলাতেও কি এরকম হয়েছে?
সম্রাট উঠে বসলেন। অবাক হয়ে দেখলেন, পনেরো জনের মতো মোঘল সৈন্য নিয়ে বৈরাম খাঁ নৌকায় দাড়ানো।
সম্রাটের চোখে পানি এসে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, বৈরাম খাঁকে পেয়েছি। আমার আর কোনো ভয় নেই।
বৈরাম খাঁ। ভালো আছেন?
সম্রাট ভালো থাকলেই আমি ভালো।
আপনাকে দেখে আমি বুকে এক শ’ হাতির বল পাচ্ছি। আল্লাহপাকের দরবারে হাজার শুকরিয়া। নৌকার তিন মাঝি হতভম্ব হয়ে তাকাচ্ছে। তারা ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছে না।
হরিশংকরকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপের সব ব্যবস্থা সম্পন্ন। বৃষ্টির পানিতে কাঠ ভেজা থাকায় আগুন ধরাতে সমস্যা হচ্ছিল। কাঠে তাপিন এবং গালা ঢেলে এই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। এখন সুন্দর আগুন জুলছে। হরিশংকর মন্ত্রমুগ্ধের মতো জ্বলন্ত আগুনের দিকে তাকিয়ে আছেন। অগ্নিমন্ত্র পাঠ করে সাধু-সন্তরা আগুন নেভাতে ও জ্বালাতে পারেন। হরিশংকর জানেন তিনি সাধু-সন্তদের একজন না। অগ্নিমন্ত্র তার ক্ষেত্রে কাজ করবে না, তারপরেও তিনি অগ্নিমন্ত্র জপ করার চেষ্টা করলেন। কিছুতেই মন্ত্রের প্রথম চরণ মনে এল না, মাঝখানের একটা লাইন শুধু মাথায় আসছে—
যা অগ্নিদায়েনো নমঃ ভূপে…
এই সময় হঠাৎ করে বিরাট হইচই শুরু হলো। সম্রাট হুমায়ূন নাকি ধরা পড়েছেন। তাকে এখানে আনা হচ্ছে। সম্ভবত হুমায়ূনকেও অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে। চরম বিশৃঙ্খলার সুযোগে হরিশংকর পালিয়ে গেলেন।
সম্রাট হুমায়ূনের ধরা পড়ার সংবাদ মিথ্যা। ধরা পড়েছে কামানচির এক সেনাপতি তোরাবি জান।
জুলন্ত অগ্নিতে তোরাবি জানকে নিক্ষেপ করা হলো।
ভগ্নহৃদয় হুমায়ূন
ভগ্নহৃদয় হুমায়ূন আগ্ৰায় পৌঁছেছেন। ফরমান জারি করেছেন, তিনি মাগরেবের নামাজের আগে কারও সঙ্গেই দেখা করবেন না। সম্রাট রোজা রেখেছেন। সূর্যাস্তের পর রোজা ভেঙে নামাজ আদায় করবেন। তারপরই যদি তার মন চায় তিনি পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন। ঘনিষ্ঠজনদের একটি তালিকাও তিনি জওহর আবতাবচির কাছে দিয়েছেন। তালিকায় আছেন তাঁর মা, কামরান মীর্জার মা এবং বোন গুলবদন।
সম্রাট বিছানায় শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। তাঁর সামান্য শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। গঙ্গা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় ডানপায়ে ব্যথা পেয়েছিলেন। সেই ব্যথা এখন প্রবল। পা ফুলে উঠেছে। তাঁর শোবার ঘরের দরজা আধাখোলা। দরজার বাইরে রুপার ছোট ঘণ্টা। সেই ঘণ্টা বেজে উঠল। সম্রাট বিরক্ত গলায় বললেন, আমি ফরমান জারি করেছি। কারও সঙ্গেই সাক্ষাৎ করব না।
কোমল নারীকণ্ঠ দরজার বাইরে থেকে বলল, আমি সম্রাটের কাছে আসি নি। আমি আমার ভাইয়ের কাছে এসেছি।
গুলবদন! কী চাও?
আমি আমার ভাইকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদতে চাই।
এসো। ভেতরে এসো।
গুলবদন ছুটে এসে বিছানায় শোয়া হুমায়ূনকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
হুমায়ূন বোনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিজেও কাঁদলেন। একটি শের আবৃত্তি করলেন। যার অর্থ, পৃথিবীর পবিত্রতম বস্তু হলো গভীর দুঃখ থেকে নিঃসৃত অশ্রুধারা।
গুলবদন বললেন, আমি সম্রাটের জন্যে দুটি আনন্দসংবাদ নিয়ে এসেছি। সম্রাট অনুমতি দিলে সংবাদ দুটি তাঁকে দেব।
হুমায়ূন বললেন, আমার বোন গুলবদন সম্রাটের অনুমতি ছাড়াই যা ইচ্ছা বলতে পারে। সে সম্রাটের অনুমতির ঊর্ধ্বে।
প্রথম সুসংবাদ। আপনার বিদ্রোহী ভাইদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হয়েছে। তারা আপনার ক্ষমার অপেক্ষায় আছে। মোঘল সাম্রাজ্যের প্রবল দুঃসময়ে তারা একত্রিত হয়ে আপনার সঙ্গে শের শাহ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবে। কামরান মীর্জা পঁচিশ হাজার সৈন্য নিয়ে প্রস্তুত। আপনার অনুমতি পেলে সে শের শাহ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবে।