সম্রাটকে চোখ মেলতে দেখেই তরুণী প্রৌঢ়কে চোখে ইশারা করল। প্রৌঢ় এগিয়ে এসে সম্রাটের মাথা তুলে ধরল। লছমি মাটির ভাড় সম্রাটের মুখের কাছে ধরে বলল, মহিষের গরম দুধ। খেলে বল পাবেন।
হুমায়ূন দুধ পান করলেন। হ্যাঁ এখন কিছুটা ভালো লাগছে। সম্রাট বললেন, জায়গাটার নাম কী?
বীরভূম।
গ্রামের নাম কী?
নোকরা।
এই নামগুলি মনে রাখতে হবে। সম্রাট ঠিক করেছেন, তিনি যদি দিল্লীতে ফিরে আবার সিংহাসনে বসতে পারেন তাহলে হতদরিদ্র এই পরিবারের ভাগ্য ফিরিয়ে দেবেন। এই কারণেই নামগুলি মনে রাখা দরকার। তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, লছমি বাই, বীরভূম, নোকরা। লছমি বাই, বীরভূম, নোকরা। লছমি বাই, বীরভূম, নোকরা…
সম্রাটের কথায় বাচ্চা ছেলেটা মজা পেয়ে হেসে উঠতেই প্রৌঢ় এসে সশব্দে তার গালে চড় দিল। চড় খেয়েও বাচ্চাটির কোনো ভাবান্তর হলো না। তার মুখ এখনো হাসি হাসি।
আচার্য হরিশংকর ভীত চোখে তাকিয়ে আছেন শের শাহ’র দিকে। শের শাহের লোকজন তাকে ধরে এনেছে।
শের শাহ বললেন, সম্রাটের মেয়ে আকিকা বেগম কোথায়?
হরিশংকর বললেন, আমি জানি না। জেনানা মহলে যখন হইচই শুরু হলো সে ছুটে গেল নদীর দিকে। আমার ধারণা সে নদীতে ড়ুবে মরেছে।
তোমার সঙ্গে একটা পুঁটলিতে বেশ কিছু ধনরত্ন পাওয়া গেছে। এগুলি কোথায় পেয়েছ?
সম্রাট হুমায়ূন উপহার হিসেবে আমাকে দিয়েছেন।
ধনরত্বের মধ্যে কানের দুল আছে, গলার হার আছে। এগুলি কি তিনি তোমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন?
আমার এক কন্যার জন্যে এইসব উপহার।
আমি যে এখন দিল্লীর সম্রাট এটা কি জানো?
জানি।
সম্রাটের সামনে মিথ্যা বলা যায় না এটা জানো?
হরিশংকর চুপ করে রইলেন।
শের শাহ্ বললেন, হুমায়ূনের মেয়ে আকিকা বেগমের মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী। তোমাকে আমি মৃত্যুদণ্ড দিলাম। তুমি জ্ঞানী মানুষ। আমি জ্ঞানকে সম্মান করি। কাজেই তোমাকে একটা বিশেষ সুবিধা আমি দেব।
সম্রাট শের শাহ’র অনেক দয়া।
শের শাহ্ বললেন, হ্যাঁ আমার অনেক দয়া। তবে পরাজিত মোঘল সম্রাট হুমায়ূনের মতো দয়া আমার নেই। তোমাকে যে বিশেষ সুবিধা আমি দেব তা হলো কোন পদ্ধতিতে তুমি মৃত্যু চাও তা তুমি ঠিক করবে। আমার হাতে অনেক পদ্ধতি আছে। যেমন–
১. হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মৃত্যু।
২. শূলদণ্ড।
৩. তলোয়ার দিয়ে মাথা কেটে আলাদা করা।
৪. আগুনে পুড়ে মৃত্যু।
হরিশংকর শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁর ঠোঁট কাঁপছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। শের শাহ্ বললেন, তুমি নিজে যদি তোমার পছন্দের কোনো বিশেষ পদ্ধতিতে মরতে চাও তাও করা হবে। বলো কী পদ্ধতিতে মরবে?
হরিশংকর কিছু বলতে পারলেন না। শের শাহ তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিয়ে দলবল নিয়ে বের হলেন—সম্রাট হুমায়ূনের খবর পাওয়া গেছে। গ্রাম নোকরা, জেলা বীরভূম।
লছমি বাইয়ের বাড়ি শের শাহ’র সৈন্যরা ঘিরে রেখেছে। লছমি বাইকে আনা হয়েছে শের শাহ’র সামনে। শের শাহ ঘোড়ার উপর বসে আছেন। তাঁর দুইপাশে দুই পুত্র। তারাও ঘোড়ার পিঠে। শের শাহ বললেন, তোমার নাম?
লছমি বাই।
হুমায়ূন কোথায়?
জানি না।
তুমি তাকে সেবা-শুশ্রুষা করেছ?
হ্যাঁ।
তুমি কি তাঁর পরিচয় জানতে?
উনি নিজেকে হিন্দুস্তানের সম্রাট বলেছিলেন। আমি বিশ্বাস করি নাই।
হুমায়ূন কোন পথে পালিয়েছেন?
লছমি জবাব দিল না। চুপ করে রইল।
তিনি কোন দিকে গেছেন তা জেনেও যদি না বলো তাহলে তোমার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। এখন বলো।
আমি বলব না।
শের শাহ তার বড় পুত্ৰ জালাল খাঁ’র দিকে তাকিয়ে বললেন, হুমায়ূন নামের ওই মানুষটার কী অদ্ভূত ক্ষমতা লক্ষ করেছ? মেয়েটি কিছুক্ষণ তাঁর সঙ্গে ছিল। এই কিছুক্ষণেই তার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। সে হুমায়ূনকে রক্ষা করবে, বিনিময়ে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। এই ঘটনা আমাদের জন্যে ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ।
দুঃসংবাদ কেন?
জাদুকরী ক্ষমতার হুমায়ূনের মতো মানুষরা যা কিছু হারায় সবই ফিরে পায়। মানুষের ভালোবাসার কারণে ফিরে পায়। মানুষের ভালোবাসা আমরাও যেন ফিরে পাই সেই চেষ্টা এখন থেকেই করতে হবে।
জালাল খাঁ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। শের শাহ্ লছমি বাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি একজন অসুস্থ, হতাশ এবং ভগ্নহৃদয় মানুষকে সেবা-যত্ন করে সুস্থ করেছ। তাঁকে রক্ষার চেষ্টা করেছ। মানুষটি আমার শক্র হলেও তোমার আচরণে আমি খুশি। এই স্বর্ণমুদ্রাটি রাখো। আমার বকশিশ।
লছমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, নড়ল না। লছমি বাইয়ের স্বামী মুখভর্তি হাসি নিয়ে এগিয়ে এল।
সম্রাট হুমায়ূন নদীপথে আগ্রার দিকে রওনা হয়েছেন। অতি সাধারণ মাছ ধরার নৌকা। নৌকার মাঝি তিনজনই বলশালী। তারা আরোহীর পরিচয় জানে না।
হুমায়ূন দুপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাচ্ছেন। কয়েকবারই তাঁর মনে হলো, পৃথিবী এত সুন্দর কেন? তার হাতে কাগজ-কলম নেই, তিনি মনে মনে একটি শের রচনা করলেন। শেরটির ভাবাৰ্থ–
আমরা বাস করি সুন্দরের মধ্যে
সুন্দরকে ঘিরে থাকে অসুন্দর।
যেমন পুণ্যের চারদিকে থাকে
পাপের শক্ত খোলস।
ভাগ্যবান সেইজন যে অসুন্দরের পর্দা ছিঁড়ে
সুন্দর দেখে। পুণ্যের কাছে যায় পাপের
শক্ত খোলস ভেঙে।।
সম্রাট নৌকার পাটাতনে শুয়ে আছেন। আকাশ মেঘে ঢাকা। হিন্দুস্থানের কঠিন রোদ এখন আর তার চোখে লাগছে না। আরামদায়ক বাতাসে চোখ বুজে আসছে। তাকে ঘুমুলে চলবে না। জেগে থাকতে হবে।