আপনি কে?
সম্রাট বললেন, আমি বাদশাহ হিন্দুস্থান।
রমণী বলল, বাদশাহ হিন্দুস্থান থাকবেন সিংহাসনে। কাদাপানিতে না।
পায়ে সামান্য কাঁটা ফুটলেও হাতির মতো প্ৰাণী অচল হয়ে যায়। আমি পায়ে কাঁটা-ফোটা হাতি। তুমি কি আমাকে কোনো খাবার দিতে পার?
আমার ঘরে ছাতু ছাড়া কিছু নেই। গুড় দিয়ে ছাতু মেখে দিলে খেতে পারবেন?
পারব। কিছু দুধ কি জোগাড় করতে পারবে? আমার শরীরের এই অবস্থায় দুধ বলকারক।
দুধের ব্যবস্থা করতে পারব।
তুমি যে সেবা আমাকে করবে তা হাজার গুণে আমি ফেরত দেব। আমি ঋণ রাখি না। তোমার নাম কী?
লছমি বাই। আমি বুঝতে পারছি আপনার নড়াচড়ার শক্তিও নেই।
আপনি শুয়ে থাকুন। আমি খাবার এবং লোকজন নিয়ে আসছি।
শুকরিয়া। আমি যে হিন্দুস্তানের সম্রাট এটা কি বিশ্বাস হচ্ছে না?
না। আপনি এক দুর্ভাগা মজনুন (পাগল)।
ভালো বলেছ, আমি এক দুর্ভাগা মজনুন।
লছমি বাই চলে গেল। তাঁর গায়ের উপর দিয়ে একটা শকুন চক্কর খাচ্ছে। এটা অলক্ষণ। শকুন আগেভাগে মৃত্যুর খবর পায়। এই শকুনটা কি বুঝে ফেলেছে তিনি মারা যাচ্ছেন? ক্লান্ত অবসন্ন সম্রাট উড়ন্ত শকুন দেখতে দেখতে আবারও ঘুমিয়ে পড়লেন।
বটগাছের নিচে দু’জন মোঘল চিন্তিত ভঙ্গিতে বসা। শের শাহ’র একদল সৈন্য বটগাছ ঘিরে আছে। তাদের কাছে খবর আছে এই দুজনের একজন দুর্ধর্ষ সেনাপতি বৈরাম খাঁ। বৈরাম খাঁকে হত্যা করে তার কাটা মাথা শের শাহ-কে দেখাতে হবে।
তোমাদের মধ্যে কে বৈরাম খাঁ?
দুজনই বলল, আমি বৈরাম খাঁ। দু’জনের একজন বৈরাম খাঁ। অন্যজন আবুল কাশেম খাঁ। তিনিও সম্রাট হুমায়ূনের একজন সেনাপতি।
তোমাদের মধ্যে একজন মিথ্যা কথা বলছ। সে কে? আঙুল তুলে দুজনই একে অন্যকে দেখালেন।
বৈরাম খাঁ’র চেহারা বৈশিষ্ট্যহীন। ছোটখাটো মানুষ। মুখের চামড়া কুঁচকানো। মাথার চুল খাবলা খাবলা করে উঠে গেছে। অন্যদিকে কাশেম খাঁ অসম্ভব রূপবান। স্বাস্থ্যু-সৌন্দর্যে ঝলমলে একজন মানুষ। কাশেম খাঁ’র মাথায় একটাই চিন্তা-যে-কোনোভাবেই হোক বৈরাম খাঁকে রক্ষা করতে হবে। অসহায় সম্রাট হুমায়ূনের এই মুহুর্তে বৈরাম খাঁকে দরকার। আবুল কাশেম খাকে না পেলেও সম্রাটের চলবে।
কাশেম খাঁ শের শাহ’র সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা চেহারা দেখে বুঝতে পারছি না কে বৈরাম খাঁ? ওই উজিবুকটা আমার নফর। সে মুনিবের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে বৈরাম খাঁ সেজেছে। তার কত বড় স্পর্ধা!
শের শাহু’র সৈন্যদের কাশেম খাঁ’র কথা যুক্তিযুক্ত মনে হলো। তারা সঙ্গে সঙ্গেই কাশেম খাঁকে হত্যা করে তার কাটা মুণ্ডু নিয়ে উল্লাস ধ্বনি করতে করতে শের শাহ’র তাঁবুর দিকে রওনা হলো। আসল বৈরাম খাঁ’র দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না।
ইতিহাস কাউকে কাউকে মনে রাখে। আবার কাউকে রাখে না। বৈরাম খাঁ’র বীরত্বগাথা ইতিহাস মনে রেখেছে। কাশেম খাঁ’র বীরত্বগাথা মনে রাখে নি।
প্রবল জ্বরে হুমায়ূন ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন। তিনি গঙ্গা নদীর তীরেই কাদামাখা অবস্থায় পড়ে আছেন। বর্ষার ক্লান্তিহীন বর্ষণ হচ্ছে। নদীর পানি ফুলে ফোঁপে উঠছে। পানি উঠে এসেছে কোমর পর্যন্ত। ধুপ ধুপ শব্দে নদীর পাড় ভাঙছে। হুমায়ূনের ধারণা হলো, পাড় ভেঙে তিনি আবারও নদীতে পড়বেন। এবার পড়লে আর রক্ষা নেই। মাশকের বাতাস বের হয়ে গেছে। সম্রাট চেষ্টা করলেন হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে। পারলেন না। আশ্চর্যের ব্যাপার শকুনটা এখনো আছে। তার মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছে। এই পাখিটির কাছে জীবন্ত প্ৰাণী অর্থহীন। মৃত প্রাণীই শুধু অর্থবহ। তিনি আবারও জ্ঞান হারালেন। অচেতন অবস্থায় তাঁর মনে হলো আকিকা বেগম তাকে ডাকছে—পিতাজি পিতাজি। তার মেয়ে কখনো তাকে পিতাজি ডাকে না। আজ কোন ডাকছে? তাকে পিতাজি ডাকে অম্বা নামের মেয়েটা। আকিকা কি অম্বার কাছ থেকে পিতাজি ডাক শিখেছে?
হুমায়ূনের কন্যা আকিকা বেগম এবং অম্বা আছে আচার্য হরিশংকরের সঙ্গে। হরিশংকর এই দুজনকে নিয়ে পালিয়েছিলেন। হরিশংকর বলেছিলেন, তোমরা আমার দুই কন্যা। আমার জীবন থাকতে তোমাদের কিছু হবে না। আমি তোমাদের লুকিয়ে রাখব। পরিস্থিতি শান্ত হলে দিল্লী পাঠানোর ব্যবস্থা করব।
হরিশংকর অম্বাকে তার গ্রামের মানুষদের হাতে তুলে দিলেন। সহমরণ থেকে পালিয়ে আসা মেয়ে হলো কলঙ্কের কলসি। এই কলসি চূৰ্ণ হওয়া প্রয়োজন। যারা এই কাজে সাহায্য করবে তারা সবাই পুণ্যের ভাগ পাবে। হরিশংকরের পুণ্য প্রয়োজন।
গঙ্গার তীরে রাতারাতি আগুন করে জ্বলন্ত অগ্নিতে অম্বাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। ভয়াবহ চিৎকারে অম্বা ডাকল, আকিকা। আকিকা।
আকিকা বেগম বান্ধবীকে বাঁচানোর জন্যে দৌড়ে আগুনে ঢুকে গেল। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ স্পর্শ করছে। সেই আগুনের ভেতর দুই বান্ধবী দুজনকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছে, পিতাজি! পিতাজি!
সম্রাট অচেতন জগৎ থেকে চেতন জগতে ফিরলেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, তিনি মাটির ঘরে দড়ির এক চৌপায়ায় শুয়ে আছেন। তাঁর গায়ে দুৰ্গন্ধ কাঁথা। মাথার কাছে কুপি জুলছে। কুপি থেকে বুনুকা বুনকা কালো ধোঁয়া উঠে ঘর অন্ধকার করে দিচ্ছে। গালভাঙা এক প্রৌঢ় খালি গায়ে তার পায়ের কাছে বসে আছে। প্রৌঢ় তার পায়ে তেল ঘষছে। চার-পাঁচ বছর বয়সের এক উলঙ্গ ছেলে কুকুরের মতো হামাগুড়ি দিয়ে বসে একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরের ভেতর চুলা জুলছে। মাটির হাঁড়িতে কিছু রান্না হচ্ছে। ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে। গঙ্গার পাড়ে দেখা হওয়া তরুণীই রাঁধছে। তরুণীর নাম সম্রাটের মনে পড়ল-লছমি বাই।