শের খাঁ’র বাহিনী ঘুমন্ত মোঘল সেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মোঘল অশ্বারোহীরা তাদের অশ্বের পিঠে জিন পরানোর সময়ও পেল না।
সম্রাটের ঘুম ভাঙল ‘পালাও’ ‘পালাও চিৎকারে। সম্রাট বিস্মিত হয়ে বললেন, কী হয়েছে?
জওহর আবতাবচি ভীত গলায় বলল, আমরা শের খাঁ কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছি, এবং পরাজিত হয়েছি। মোঘল সৈন্যদের প্রায় সকলেই হত।
সম্রাট বললেন, আমি কি দুঃস্বপ্ন দেখছি?
জওহর আবিতাবচি বলল, না। সম্রাট, আপনাকে এক্ষুনি পালাতে হবে।
আহত মোঘল সেনাদের আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছে। মহিলা এবং শিশুদের কান্না শোনা যাচ্ছে।
হুমায়ূন ভেবে পেলেন না, তার তাঁবু কেন আক্রান্ত হয় নি। শের খাঁ’র উচিত ছিল সবার আগে সম্রাটকে হত্যা করা। এখানে কি শের খাঁ’র কোনো হিসাব আছে?
সম্রাট ঘোড়ায় চড়ে কীর্তিনাশা নদীর পাড়ে গেলেন। পুল ভাঙা। শত শত মোঘল সৈন্য পুলে উঠে সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে পানিতে পড়ছে। নদীর স্রোতে ভেসে চলে যাচ্ছে। হাতিগুলিরও মনে হয় মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়েছে। তারা কিছুতেই পানিতে নামবে না। অথচ এরা শিক্ষিত হাতি। যুদ্ধক্ষেত্রের সব পরিস্থিতির জন্যে তৈরি।
হুমায়ূন পেছন দিকে তাকালেন, তার তাঁবুতে আগুন জ্বলছে। আগুন ছুটে যাচ্ছে জেনানা তাঁবুর দিকে। আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ লাল। সম্রাট হুমায়ূনের ইমাম সাহেব উচ্চস্বরে আযান দিচ্ছেন, আল্লাহু আকবার। আল্লাহু আকবার। মহাবিপদের সময় আযান দিতে হয়। আজ মোগলদের মহাবিপদ।
সম্রাট ঘোড়া নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন। মুহুর্তের মধ্যে ঘোড়া পানিতে তলিয়ে গেল। সম্রাট নিজেও তলিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ শুনলেন, কে যেন বলছে আমি আপনার দিকে একটা বাতাস ভর্তি মশক ছড়ে দিচ্ছি। আপনি মশক ধরে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করুন।
তুমি কি আমাকে চেনো?
আপনি মোঘল সম্রাট হুমায়ূন।
তোমার নাম কী?
আমি নাজিম। ভিস্তিওয়ালা নাজিম। আপনি মশক শক্ত করে ধরে ভাসতে থাকুন।
নদীর প্রবল স্রোতে হুমায়ূন ভেসে যেতে শুরু করেছেন। তিনি দূর থেকে বললেন, আমি যদি বেঁচে যাই, যদি দিল্লীর সিংহাসনে বসতে পারি। তাহলে তোমার সৎকর্মের প্রতিদান আমি দেব। একদিনের জন্যে হলেও তুমি দিল্লীর সিংহাসনে বসবে।
ভোর হয়েছে।
হুমায়ূন-পত্নী বেগা বেগম শের খাঁ’র হাতে বন্দি হয়েছেন। ভয়ে এবং আতঙ্কে তিনি অস্থির। পরাজিত সম্রাটের স্ত্রীর জন্যে কী অসম্মান অপেক্ষা করছে তা তিনি জানেন। রাজপুত রমণীরা এমন অবস্থায় আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে জহর ব্ৰত পালন করেন। মুসলমানদের জন্যে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ বলে এমন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।
বেগা বেগমকে শের খাঁ’র সামনে উপস্থিত করা হলো। শের খাঁ বললেন, আপনি কাঁদছেন কেন?
বেগা বেগম বললেন, অসম্মানের ভয়ে কাঁদছি।
মা, শুনুন। আপনি যা ইচ্ছা করবেন তা-ই করা হবে। আমি আপনাকে মা ডেকেছি। পুত্রের হাতে মা’র কোনো অসম্মান হবে না এটা আপনি জানেন। আপনি কী চান বলুন?
আমি দিল্লী যেতে চাই।
আপনাকে এবং আপনার সঙ্গে যেসব মহিলা এবং শিশু আছে তাদের সবাইকে আমি এক্ষুনি দিল্লী পাঠাবার ব্যবস্থা করছি।
সম্রাট হুমায়ূনের নয়নমণি আকিকা বেগম এবং তার এক বান্ধবী অম্বাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি তাদের সন্ধানে লোক পাঠাচ্ছি। মা, আপনার আর কিছু কি লাগবে?
বেগা বেগম বললেন, অজুর পানি লাগবে। জয়নামাজ লাগবে। আমি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ব।
নফল নামাজ শেষে প্রার্থনায় বসে হুমায়ূন-পত্নী বেগা বেগম বললেন, হে পরম করুণাময়, তোমার বান্দা শের খাঁ যে সম্মান আমাকে দিয়েছে সেই সম্মান তুমি তাকে বহুগুণে বর্ধিত করে ফেরত দিয়ে। হুমায়ূন-পত্নী হয়েও আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, শের খাঁ যেন তার জীবনে কখনোই কোনো যুদ্ধে পরাজিত না হয়। (*চৌসার যুদ্ধের পর শের খাঁ কখনোই কোনো যুদ্ধে পরাজিত হন নি। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল নিজের একটা কামানের বিস্ফোরণে।)
শুক্রবার। জুম্মার নামাজের সময় হয়েছে। শের খাঁ’র হাতে বন্দি সম্রাট হুমায়ূনের ইমামকেই নামাজ পড়াতে বলা হলো। ইমাম খুৎবায় হুমায়ূনের নাম নিলেন।
শের খাঁ বললেন, খুৎবা পাঠে সামান্য ভুল হয়েছে। ভুল কী হয়েছে ইমাম সাহেব জানেন। তাঁকে নতুন করে খুৎবা পাঠ করতে বলা হচ্ছে।
দ্বিতীয় দফায় খুৎবায় শের খাঁর নাম পাঠ করা হলো। নামাজের শেষে শের খাঁ নিজেকে ভারতের সম্রাট ঘোষণা করে শাহ্ উপাধি গ্ৰহণ করলেন। শের খাঁ হলেন শের শাহ্।
আপনি খুশি না আয়ে
আপনি খুশি না আয়ে
না আপনি খুশি চলে,
লাই হায়াত আয়ে,
কাজা লে চলি চলে।
(পৃথিবীতে নিজের খুশিমতো আসি নি, খুশিমতো চলেও যাব না। জীবন হাত ধরে নিয়ে এসেছিল বলেই এসেছি। মৃত্যু হাত ধরে নিয়ে চলে যাবে, তখন চলে যাব।)
সম্রাট হুমায়ূন মশক বুকে জড়িয়ে গঙ্গা নদীর তীরে শুয়ে আছেন। কখন নদীর স্রোত তাকে তীরে এনে ফেলেছে, তিনি জানেন না। অবসাদে, ক্লান্তিতে, হতাশা ও বিষণ্ণতায় তার চোখ বন্ধ। তিনি ঘুম এবং জাগরণের মাঝামাঝি অবস্থায় আছেন। তার চোখের পাতা বন্ধ। সেই বন্ধ পাতা ভেদ করেও সূর্যের আলো তার চোখে ঢুকে যাচ্ছে। চোখ কটকট করছে, কিন্তু তিনি মাথা ফেরাতে পারছেন না।
আপনার কী হয়েছে?
সম্রাট অনেক কষ্টে চোখ মেললেন। ঘোর কৃষ্ণবর্ণের এক রমণী কলসি হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে। সে গঙ্গার পানি নিতে এসেছিল। রমণীর বয়স অল্প। মুখশ্ৰী কোমল।