আপনার যদি এরকম নির্দেশ হয়। আমি যাব। এখন আপনার অনুমতি নিয়ে আমি তাঁবুতে ফিরে যেতে চাই। বাংলা মুলুকের প্রচণ্ড তাপে আমি বিপর্যন্ত বোধ করছি।
সম্রাট বললেন, আপনি নিজের তাঁবুতে ফিরে যান। বিশ্রাম করুন।
বৈরাম খাঁ তাঁবুতে ফিরেই শের খাঁ’র পত্রের জবাব দিলেন। সেখানে লিখলেন,
পাঠানদের প্রতিনিধি
শের খাঁ,
আপনার পত্র পাঠ করেছি। আমার পক্ষে কোনোক্রমেই সম্রাট হুমায়ূনকে একা ফেলে আপনার কাছে যাওয়া সম্ভব না।
ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক
বৈরাম খাঁ
দিন বৃহস্পতিবার। সময় সুবেহ্ সাদেক।
শের খাঁ তার দুই পুত্র এবং প্রধান সেনাপতি খাওয়াস খাকে নিয়ে গোপন বৈঠকে বসেছেন। শের খাঁ বললেন, আজ মধ্যরাতে আমরা মোঘল বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বা। কারও কিছু বলার আছে?
কেউ জবাব দিল না। খাওয়াস খাঁ বললেন, আজকের রাতটা কি বিশেষ কারণে ঠিক করা হয়েছে?
শের খাঁ বললেন, হ্যাঁ। আমরা মুসলমানরা দিনগণনা করি চন্দ্র দেখে। সেই হিসাবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবারের শুরু। শুক্রবারে মুসলমানরা যুদ্ধযাত্রা করে না। মোঘল বাহিনী নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাবে। আমরা মুসলমান হয়েও ঝাঁপিয়ে পড়ব।
খাওয়াস খাঁ বললেন, দিন নির্ধারণ ঠিক আছে।
শের খাঁ বললেন, মোঘল বাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হবে এই বিষয়ে আমি একশত ভাগ নিঃসন্দেহ। আমি ঝাড়খণ্ডের দলপতির নামে একটা মিথ্যা গল্প তৈরি করেছি। বারবার তার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছি। মোঘলরা তা বিশ্বাস করেছে। আমাদের দুটা লাভ হয়েছে। এক, মোঘলদের বিশ্বাস অর্জন। দুই, দ্রুত যুদ্ধযাত্রা করার অনুশীলন।
শের খাঁ’র পুত্র সাইফ খাঁ বললেন, বারবার ঝাড়খণ্ডের দলপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা যে একটি অনুশীলনের অংশ তা আমি আগে বুঝতে পারি নি।
শের খাঁ বললেন, এখন আমি কিছু কঠিন নির্দেশ দেব। এইসব নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে।
প্রথম নির্দেশ
সম্রাট হুমায়ূনকে কোনো অবস্থাতেই হত্যা বা গ্রেফতার করা যাবে না। তাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
শের খাঁ’র পুত্ৰ জালাল খাঁ বললেন, আপনার এই নির্দেশের পেছনে কারণ কী?
শের খাঁ বললেন, একটিই কারণ। মানুষ হিসেবে আমি সম্রাটকে অত্যন্ত পছন্দ করি। আমি আমার দিক থেকে তার কোনো অমঙ্গল হতে দেব না।
দ্বিতীয় নির্দেশ
সম্রাটের পরিবারের সমস্ত নারী ও শিশু এবং তার হেরেমের নারীদের কোনোরকম অসম্মান বা ক্ষতি করা যাবে না।
তৃতীয় নির্দেশ
যে-কোনো মূল্যে বৈরাম খাঁকে হত্যা করতে হবে। বৈরাম খাঁ সিংহের মতো সাহসী আবার শৃগালের চেয়েও ধূর্ত। বৈরাম খাঁ বিহীন হুমায়ূন কোনো শক্তিই না।
শের খাঁ বললেন, এখন খাওয়াস খাঁ’র দায়িত্ব হলো বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাড়খণ্ডের চেরুহ। দলপতির বিরুদ্ধে মিথ্যা যুদ্ধযাত্রা করা। সম্রাট হুমায়ূন যেন খবর পান। আপনি দলপতিকে শায়েস্তা করতে যাচ্ছেন-আমি সেই ব্যবস্থা করব। আপনি সন্ধ্যা নামার পর ফিরে আসবেন।
খাওয়াস খাঁ বললেন, আমি কি এখনই যাত্রা করব?
শের খাঁ বললেন, এই মুহুর্তে।
ভোরবেলা নাশতা খেতে খেতে হুমায়ূন শুনলেন, শের খাঁ’র বিশাল বাহিনী খাওয়াস খাঁ’র নেতৃত্বে চেরুহ দলপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছে।
হুমায়ূন দুঃখিত গলায় বললেন, শের খাঁ বেচারা ভালো ঝামেলায় আছে।
সারাটা দিন সম্রাটের আনন্দে কাটল। তিনি তার কন্যা আকিকা। বেগমের সঙ্গে পাশা খেললেন। আকিকা বেগম পাশা খেলায় পিতাকে হারিয়ে দিলেন। সম্রাট কন্যার কাছে হেরে প্রভূত আনন্দ পেলেন। তিনি একটি শের আবৃত্তি করলেন। এই শেরটির ভাবাৰ্থ–
সেই ব্যক্তিই সৌভাগ্যবান যে বুদ্ধিতে নিজ পুত্ৰ-কন্যার হাতে পরাস্ত হয়।
আকিকা বেগম বলল, বাবা, আমি তোমাকে বুদ্ধিতে হারাই নি। পাশার দানে হারিয়েছি।
হুমায়ূন হাসতে হাসতে বললেন, একই ব্যাপার।
অম্বা মেয়েটির সঙ্গেও কিছু কথা বললেন। হুমায়ূন বললেন, আমার এখানে তুমি কি সুখে আছ?
অম্বা বলল, মহা সুখে আছি। আমি ইসলাম ধর্ম গ্ৰহণ করতে চাই।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। আরও চিন্তা করো। সম্রাট দুপুরে আচার্য হরিশংকরের সঙ্গে বসলেন। তাঁর অনুবাদ শুনলেন। সর্বমোট দশ পৃষ্ঠা অনুবাদ হয়েছে। সম্রাট আচার্যকে দশটি রৌপ্যমুদ্রা দিলেন।
মাগরেবের নামাজের পর কোনোরকম খবর না দিয়ে সম্রাট উপস্থিত হলেন জেনানা তাঁবুতে। মহিলারা অভিভূত। অনেকদিন তাঁরা সম্রাটের দর্শন পায় না।
হুমায়ূন বললেন, দিল্লী ফিরে গেলে কেমন হয়?
সবাই একসঙ্গে বলল, খুব ভালো হয়।
আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে দিল্লীর দিকে রওনা হব।
মহিলাদের আনন্দের সীমা রইল না। তাদের আগ্রহে সম্রাট রাতের খাবার জেনানা তাঁবুতে গ্ৰহণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। রাতের খাওয়ার শেষে গানবাজনার আয়োজন করা হলো।
আনন্দেরও এক ধরনের ক্লান্তি আছে। সম্রাট সেই ক্লান্তি নিয়ে রাতে ঘুমুতে গেলেন।
শের খাঁ’র বাহিনী কীর্তিনাশা নদীর উপরের কাঠের পুল দিয়ে পার হলো। শের খাঁ বিস্মিত হলেন। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি পুল, সেখানে কোনো পাহারা নেই। শের খাঁ’র হস্তীবাহিনী কীর্তিনাশা সাঁতরে পার হলো।
মোঘল বাহিনীর পেছনে শের খাঁ’র সৈন্যদল। মোঘলরা আছে কীৰ্তিনাশা এবং গঙ্গার সঙ্গমস্থলে। পাঠানদের আক্রমণ শুরু হলে মোঘলদের যেতে হবে নদীর দিকে। শের খাঁ’র নির্দেশে কীর্তিনাশার কাঠের পুল ভেঙে দেওয়া হলো।