সম্রাট ঠিক করেছেন, জাদুবিদ্যার বইটির অনুবাদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি চৌসাতে থাকবেন। শের খাঁ’র সঙ্গে সন্ধি করে দিল্লী ফিরে যাবেন। পেছনে শক্র রাখা কোনো কাজের কথা না।
সন্ধির শর্ত নিয়ে আলোচনার জন্যে সম্রাটের দূত শায়েখ খলিলকে শের খাঁ’র কাছে পাঠানো হলো। শর্তগুলো নিম্নরূপ–
প্ৰথম শর্ত
শের খাঁ তার অবস্থান থেকে পেছনে সরে যাবেন, যাতে ইচ্ছা করলেই মোঘল বাহিনী কীর্তিনাশা নদী পার হতে পারে।
দ্বিতীয় শর্ত
শের খাঁ তার পুরোনো জায়গির বাংলা ও বিহার ফিরে পাবেন ঠিকই, তবে তাকে নিয়মিত কর পরিশোধ করতে হবে। তিনি খুৎবা পড়বেন সম্রাট হুমায়ূনের নামে। টাঁকশালের মুদ্ৰাও মোঘল সম্রাটের নামে তৈরি হবে।
তৃতীয় শর্ত
শের খাঁ’র এক পুত্রকে (সম্রাটের পছন্দ সাইফ খাঁ) থাকতে হবে দিল্লী দরবারে, সম্রাটের নজরদারিতে।
চতুর্থ শর্ত
শের খাঁ স্বয়ং হুমায়ূনের সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। তিনি আফগান এবং মোঘল সুসম্পর্কের জন্যে ভূমিকা রাখবেন।
শের খাঁ প্রতিটি শর্ত মেনে নিলেন। নিজের অবস্থান থেকে কুড়ি মাইল পেছনে সরে গেলেন। হুমায়ূনের কীর্তিনাশা নদী অতিক্রমে কোনো বাধা রইল না।
সম্রাট তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে নদী অতিক্রম করলেন না, তবে তিনি সপ্তাহে একদিন নদীর তীরে স্বয়ং উপস্থিত হতে লাগলেন। ওই বিশেষ দিনে দুই শুড়ের হস্তী শাবককে গোসল করানো হয়। গোসলের সময় সে তার দুই শুড় দিয়ে একসঙ্গে আকাশে পানি ছুঁড়ে মারে। সেই পানি বৃষ্টির মতো তার গায়ে নেমে আসে। অদ্ভুত দৃশ্য।
মঙ্গলবার দ্বিপ্রহর। সম্রাট কীর্তিনাশা নদীর তীরে। হান্তীশাবকের স্নানদৃশ্য দেখছেন। সম্রাটের সঙ্গে আছেন। বৈরাম খাঁ। বৈরাম খাঁকে চিন্তিত এবং বিষগ্র দেখাচ্ছে। হস্তীশাবকের জলকেলি দেখে তিনি তেমন আনন্দ পাচ্ছেন না। সম্রাট বললেন, বৈরাম খাঁ, আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
বৈরাম খাঁ বললেন, আমি চিন্তিত বলেই মনে হয় চিন্তিত দেখাচ্ছে।
চিন্তিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা কি ঘটেছে?
আমি শের খাঁকে নিয়ে চিন্তিত। সে সাপের মতো ধূর্ত।
সম্রাট হাসতে হাসতে বললেন, সাপ ধূর্ত না, ভীতু প্রাণী। শের খাঁ যদি সাপও হয় সেই সাপ এখন গর্তে ঢুকেছে। সাপ যখন গর্তে ঢোকে সোজা হয়ে ঢোকে।
বৈরাম খাঁ বললেন, সাপ যখন গর্ত থেকে বের হয় তখন কিন্তু আবার একেবেঁকেই চলে।
এই সাপ সহজে গর্ত থেকে বের হবে না।
বৈরাম খাঁ ক্লান্ত গলায় বললেন, শের খাঁ ছাড়াও চিন্তিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আপনার ভাই কামরান মীর্জা নিজের নামে খুৎবা পাঠ শুরু করেছেন। নিজের নামে স্বর্ণমুদ্রা বের করেছেন।
সম্রাট বললেন, এটি কামরানের শিশুসুলভ কার্য। শিশুদের সব কাজ গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে নেই। যথাসময়ে সে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
এবং আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন?
হ্যাঁ।
আপনার আরেক ভ্রাতা হিন্দাল মীর্জাকে রসদের জন্যে পাঠানো হয়েছিল। তিনি কুড়ি হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে রসদ সংগ্রহে বের হয়ে আর ফিরে আসেন নি। খবর পাওয়া গেছে। তিনি দিল্লীর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। মনে হচ্ছে তারও দিল্লীর সিংহাসনে বসার বাসনা।
সম্রাট একটি শের আবৃত্তি করলেন। ফার্সি শের, যার ভাবাৰ্থ–
বৃদ্ধকে সম্মান করো, এই সম্মান তাঁর অভিজ্ঞতার কারণে, যুবককে সমীহ করো, এই সমীহ তার তারুণ্যের কারণে, শিশুকে ভালোবাসো, এই ভালোবাসা তার শিশুসুলভ কর্মকাণ্ডের জন্যে।
বৈরাম খাঁ বিরস গলায় বললেন, প্রতিটি শের কবির ব্যক্তিগত ধ্যানধারণার ফসল। ব্যক্তিগত কোনো কিছুই সর্বজনীন হতে পারে না। যাই হোক, আমি হস্তীশাবকের স্নান দেখার জন্যে আসি নি। আমি শের খাঁর কাছ থেকে একটি পত্র পেয়েছি। পত্রটি আপনাকে পড়ে শোনানোর জন্যে এসেছি। সম্রাটের অনুমতি পেলে পত্রটি পড়তে চাই।
পড়ুন। বৈরাম খাঁ পত্রটি পড়লেন :
সিংহের চেয়ে সাহসী, দিল্লীর সূর্য সম্রাট হুমায়ূনের প্রিয়ভাজন, বৈরাম খাঁ।
আমার অভিনন্দন এবং সালাম।
আপনি ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই অবগত হয়েছেন যে, সন্ধির সকল শর্ত মেনে আমি আমার বাহিনী নিয়ে দূরে সরে গেছি। আমার পুত্র সাইফ খাঁকে নির্দেশ দিয়েছি সে যেন সম্রাটের সঙ্গে দিল্লী যাত্রা করে।
আমি যে-কোনো এক শুভদিনে সম্রাটের সামনে উপস্থিত হব। তাঁর পদচুম্বনের দুর্লভ সুযোগের আশায় কালযাপন করছি।
এক্ষণ, আপনাকে পত্রদানের কারণ ব্যাখ্যা করি। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, ঝাড়খণ্ডের দলপতিদের চোরা গোপ্ত হামলায় আমি বিপর্যন্ত।
সম্রাট হুমায়ূনের দীন সেবক হিসেবে এবং দিল্লীর সিংহাসনের প্রতি অতি অনুগত ভৃত্য হিসেবে আমি কি আপনার কাছ থেকে কিছু পরামর্শ পেতে পারি?
ঝাড়খণ্ডের দলপতিদের কীভাবে সমুচিত জবা দেওয়া যায়—এই বিষয়ে পরামর্শ।
সম্রাটের অনুমতি সাপেক্ষে আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আপনাকে সসম্মানে আমার তাঁবুতে আনার ব্যবস্থা আমি করব।
পত্রের উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম।
ইতি
আপনার গুণমুগ্ধ,
মোঘল সম্রাট হুমায়ূনের দীন সেবক,
শের খাঁ
সম্রাট বললেন, পত্রের কী জবাব দেবেন বলে ঠিক করেছেন?
বৈরাম খাঁ বললেন, আপনি যে জবাব দিতে বলবেন আমি সেই জবাবই দেব।
আমি মনে করি শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে আপনি শের খাঁ’র সঙ্গে দেখা করতে পারেন।