হরিমতি এখন আছে আকিকা বেগমের তত্ত্বাবধানে। আকিকা। বেগম এবং তার বান্ধবী অম্বা হরিমতিকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। আকিকা বেগম হন্তীশাবকের হিন্দু নাম বদলে মুসলমান নাম রাখতে চাচ্ছে। অনেকগুলি নাম সে তার কোরানপাঠ শিক্ষক ওস্তাদের সাহায্যে আলাদা করেছে। কোনোটিই পছন্দ হচ্ছে না। যেমন
নাম—অর্থ
শাহানা—রানী
লাবিবা—জ্ঞানী
আনিসা—কুমারী
সাইয়ারা–রাজকুমারী
সাইয়ারা নাম তার কিছুটা পছন্দ হচ্ছে। কিন্তু সে চাচ্ছে তার নামের প্রথম অক্ষরের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখতে। আনিসা নাম সেই অর্থে ঠিক আছে। ‘আ’ দিয়ে শুরু। কিন্তু নামের অর্থ (কুমারী) পছন্দ হচ্ছে না। হরিমতি নিশ্চয়ই সারা জীবন কুমারী থাকবে না।
হরিমতিকে নিয়ে সম্রাটের অন্য পরিকল্পনা আছে। তিনি এই অদ্ভুত হস্তী শাবক পারস্য-সম্রাট শাহ তামাস্পকে উপহার হিসেবে দিতে চান। পারস্য-সম্রাটের জীবজন্তুর প্রতি প্রবল আগ্রহ। তাঁর চিড়িয়াখানা সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে আনা জীবজন্তুতে পরিপূর্ণ। শাহ এই অদ্ভুত উপহার পেয়ে অবশ্যই আনন্দে আত্মহারা হবেন। পারস্যের সঙ্গে তখন সুসম্পর্ক হবে। এর ফলাফল হবে শুভ।
শুক্রবার জুমার নামাজ শেষ করে সম্রাট বিশ্রামে গেছেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তিনি দুপুরের খাবার খাবেন। ঘুমে সম্রাটের চোখ লেগে আসছে, তখনই তাকে ডেকে তোলা হলো। তাঁকে দুঃসংবাদ দেওয়া হলো। শের খাঁ’র পুত্র সাইফ খাঁ প্ৰায় এক হাজার অশ্বারোহী নিয়ে মোঘল শিবির আক্রমণ করেছে। যুদ্ধের জন্যে মোঘলদের প্রস্তুতি ছিল না বলে অল্পকিছু মোঘল সৈন্য নিহত হয়েছে। সাইফ খাঁ সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়েছে। তাকে বন্দি করা হয়েছে। সাইফ খাঁ’র সঙ্গের সৈন্যদের প্রায় সবাই নিহত হয়েছে।
সাইফ খা-কে সম্রাটের সামনে আনা হলো। সম্রাট দেখলেন নিতান্তই অল্পবয়সী অতি সুপুরুষ এক যুবক।
মোঘলবাহিনীকে আক্রমণ করেছ। এটা কি তোমার নিবুদ্ধিতা নাকি কোনো কৌশল?
সাইফ খাঁ মাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি বিশাল বাহিনী নিয়েই এসেছিলাম। বেশিরভাগই ছিল ভাড়াটে সৈন্য। যুদ্ধ শুরু হওয়ামাত্র তারা পালিয়ে গেছে।
বন্দি শক্রকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে মারার রেওয়াজ মোঘলদের আছে, এই তথ্য তুমি জানো?
জানি।
তুমি কি আমার কাছে প্ৰাণভিক্ষা চাও?
সাইফ খা’ বললেন, আপনার করুণা এবং দয়ার কথা আমি জানি। আপনি যে আমার প্রাণ ভিক্ষা দেবেন। সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
আমি এখন দুপুরের খাবার খাব। তুমি আমার সঙ্গে খেতে বসে। খাওয়ার পর তোমার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। আচ্ছা তুমি যেন শান্তিমতো খেতে পার আমি সেই ব্যবস্থা করছি। তোমাকে ক্ষমা করা হলো। তুমি শের খাঁ’র কাছে ফিরে যাবে এবং তাকে বলবে তার পাঠানো উপহার আমার পছন্দ হয়েছে।
আমি বাবাকে এই সংবাদ দেব।
সম্রাট বললেন, আমি তোমার পিতার সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে দিল্লী ফিরে যাব।
এই খবরও বাবাকে জানাব। তিনি খুশি হবেন।
সম্রাট হুমায়ূন সাইফ খাঁ-কে ডানপাশে বসালেন। অতি সম্মানিতজনকেই এমন সম্মান দেখানো হয়।
জায়গাটার নাম চৌসা
জায়গাটার নাম চৌসা। গঙ্গা এবং কীৰ্তিনাশা নদীর সঙ্গমস্থলে ছোট একটা গ্রাম। চৌসার দক্ষিণে হুমায়ূনের বিশাল বাহিনী আস্তানা গেড়েছে। নদীর একদিকে মোঘল বাহিনী, অন্যদিকে শের খাঁ’র আফগান বাহিনী। মাঝখানে খরস্রোতা কীর্তিনাশা নদী। আফগান বাহিনী নদী পার হয়ে মোঘল বাহিনীকে আক্রমণ করবে সেই সম্ভাবনা শূন্য। নদীতে নড়বড়ে কাঠের পুল আছে। সেই পুলে বিশাল বাহিনী পার হতে পারবে না। পুলের উপর কামান গাড়ি তোলার প্রশ্নই আসে না।
হুমায়ূনের গুপ্তচর খবর এনেছে শের খাঁ পর্যুদস্ত অবস্থায় আছেন। ঝাড়খণ্ডের চেরুহ। দলপতি শের খাঁকে আক্রমণ করবে। এই নিয়েই শের খাঁ ব্যস্ত। কিছুদিন পরপর নিশাকালে শের খাঁ’র প্রধান সেনাপতি খাওয়াস খাঁ চেরুহ। দলপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্ৰা করেন। তার দেখা না পেয়ে ফিরে আসেন। শের খাঁ যে সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন তাতে বিশাল মোঘল বাহিনীর উপর আক্রমণ চালানোর প্রশ্নই ওঠে না। শের খাঁ চাইবেন যে-কোনো মূল্যে মোঘলদের সঙ্গে সন্ধি।
মোঘল সম্রাট নিশ্চিন্ত মনে সময় কাটাচ্ছেন। জাদুবিদ্যার বইটির পাঠোদ্ধারের ব্যবস্থা হয়েছে। বইটি প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় লেখা। সেই ভাষার একজন পণ্ডিত বইটি ফার্সি ভাষায় অনুবাদ শুরু করে দিয়েছেন। পণ্ডিত হিন্দু ব্ৰাহ্মণ, নাম আচার্য হরিশঙ্কর বিদ্যাবাচস্পতি। তিনি প্রতি পৃষ্ঠা অনুবাদ করার জন্যে পাচ্ছেন একটি করে রৌপ্যমুদ্রা।
সম্রাট নতুন এক খেয়ালেও কিছু সময় দিচ্ছেন। তিনি হিন্দুস্থানি রান্নার একটি কোষগ্রন্থ তৈরি করতে চাচ্ছেন। বিশাল হিন্দুস্থানের নানান অঞ্চলে কত ধরনের রান্নাই-না হয়। সব একত্রিত থাকলে গবেষকদের জন্যে সুবিধা। হিন্দু বিধবারা (যারা নানান কারণে সতীদাহের হাত থেকে বেঁচে গেছে) মাছ-মাংস খেতে পারে না। তাদের জন্যে বিচিত্র সব নিরামিষ রান্না হয়। বিচিত্র নিরামিষের একটি খেয়ে সম্রাট আনন্দ পেয়েছেন। কাঁঠাল নামের একটি কাঁচা ফল থেকে এই নিরামিষ তৈরি হয়। খেতে মাংসের মতো লাগে। সম্রাট শুরুতে ধরতেই পারেন নি তিনি নিরামিষ খাচ্ছেন, মাংস না। হিন্দুস্থানি রান্নার আকরগ্রন্থ তৈরির বাসনার মূলে আছে কাঁঠালের নিরামিষ।