ফিরোজ সারাঙ্গখানি দুঃস্বপ্ন কী জানতে চাচ্ছেন। কিন্তু সম্রাটের দুঃস্বপ্ন জানতে চাওয়া যায় না। বড় ধরনের বেয়াদবি।
সম্রাট বললেন, দুঃস্বপ্ন কী জানতে চাও? শোনো। আমি দেখলাম আমার তাঁবুতে একটা ভেড়া ঢুকে পড়েছে। ভেড়াটার একটা পা নেই, সে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। ভেড়াটা লাফ দিয়ে আমার কোলে এসে পড়ল এবং আমার পায়ে মুখ ঘষতে লাগল। তখনই ঘুম ভাঙল।
স্বপ্নের ফলাফল অবশ্যই শুভ।
একটা পঙ্গু ভেড়া লাফ দিয়ে আমার কোলে এসে উঠল। এর ফলাফল শুভ কীভাবে হয়? হুজুর মীর আবুবকার-এর কাছ থেকে স্বপ্নের তফসির জানতে হবে।
কথা বলতে বলতেই বাবর তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। অনেক দূরে ধুলার ঝড়ের মতো উঠেছে। অশ্বারোহীর দল কি ছুটে আসছে? কোনো বিদ্রোহী বাহিনী? হওয়ার তো কথা না। অশ্বারোহীর দল আগ্রার দিক থেকেই আসছে। এমন কি হতে পারে আগ্রার দুর্গে বন্দি গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমাদিত্যের পরিবারকে উদ্ধার করতে সাহায্যকারী কেউ এসেছে?
বাবর ইশারা করলেন। মুহুর্তের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার পরিস্থিতি তৈরি হলো। সিঙ্গা বাজানো হলো। বাদশাহের প্রিয় পিতজুচাক ঘোড়া নিয়ে একজন ছুটে এল। বাদশাহ তখন্তু রওয়ান ছেড়ে ঘোড়ায় উঠলেন। দূরে ধুলার ঝড় ঘন হচ্ছে। সৈন্যসংখ্যা আন্দাজ করা যাচ্ছে নাৰী মাঝে মাঝে রোদে ঘোড়ার আরোহীদের শিরস্ত্ৰাণ ঝলসে ঝলসে উঠছে।
বাবরের সংবাদ সরবরাহ দলের চারজন ঘোড়সওয়ার ছুটে যাচ্ছে। তাদের হাতে আয়না, তারা আয়নার আলো ফেলে বোঝার চেষ্টা করবে কারা এসেছে।
সম্রাট বাবরের চোখমুখ শুক্ত-দৃষ্টি তীক্ষ। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি সহজ হলো। তিনি শরবতের গ্রাসের দিকে হাত বাড়ালেন। সৈন্যবাহিনী নিয়ে কে আসছেন তিনি জানেন আসছে পুত্র হুমায়ূন মীর্জা।
যুদ্ধাবস্থার তাতে পরিবর্তন হলো না। সম্রাটদের পুত্র থাকে না, ভাই থাকে না। তাঁরা সবসময়ই একা। হুমায়ূন যে সসৈন্যে তাকে আক্রমণ করতে আসছে না এর নিশ্চয়তা কোথায়? হুমায়ূন মীর্জার অধীনে বিশাল সৈন্যবাহিনী আছে। আগ্রা দুর্গ দখল করার জন্যে পাঁচশ (অশ্বারোহীর একটি বিশেষ দল সম্প্রতি দেওয়া হয়েছে। বাবর বিড়বিড় করে নিজের রচনা চারপদী কবিতা আবৃত্তি করলেন—
সম্রাটের বন্ধু তার সুতীক্ষ্ণ তরবারি
এবং তার ছুটন্ত ঘোড়া আর তার বলিষ্ঠ দুই বাহু
তার বন্ধু নিজের বিচার
এবং পঞ্জরের অস্থির নিচের কম্পবান হৃদয়
হুমায়ূন মীর্জা ঘোড়া থেকে নেমে এগিয়ে আসছেন। তিনি বাবার সামনে এসে নতজানু হয়ে দাঁড়ালেন। তার হাতে নীল রেশমি রুমালে কী যেন লুকানো। বাঁ হাতে রুমাল রেখে ডান হাতে তিনি নিজের কপাল স্পর্শ করে সেই হাতে ভূমি স্পর্শ করলেন। তিনবার এই কাজটি করে কুর্নিশ পর্ব শেষ করা হলো।
বাবর বললেন, পুত্ৰ, তোমার হাতে কী?
হুমায়ূন বললেন, সামান্য উপহার।
পিতার প্রতি পুত্রের উপহার কখনোই সামান্য না।
হুমায়ূন বললেন, অতি মহাৰ্য উপহারও মহাপুরুষের কাছে সামান্য।
বাবর প্রীত হলেন। কবিতার এই চরণটি তাঁর লেখা। পুত্ৰ মনে করে রেখেছে এবং সময়মতো বলতে পেরেছে। বাবর বললেন, উপহার দেখাও।
হুমায়ূন মীর্জা রেশমি রুমাল খুললেন। তাতে হাতে পায়রার ডিমের চেয়েও বড় একটা হীরা। সূর্যের আলো হীরাতে পড়েছে। মনে হচ্ছে হাতে আগুন লেগে গেছে। বাবর মুগ্ধ গলায় বললেন, বাহ্!
হুমায়ূন মীর্জা বললেন, এই হীরার নাম কোহিনূর। এর ওজন আট মিস্কাল্। বলা হয়ে থাকে এই কোহিনূরের মূল্যে সারা পৃথিবীর সকল মানুষ দু’দিন পানাহার করতে পারবে।
এটা কি সেই কোহিনূর যা সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি ভারতে এনেছিলেন?
এটি সেই কোহিনূর। আপনি হাতে নিলে আমি খুশি হব।
সম্রাট বাবর হীরকখণ্ড হাতে নিলেন। মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ দেখলেন। তারপর বললেন, পুত্র তোমার উপহার পেয়ে আমি খুশি হয়েছি। এতই খুশি হয়েছি যে এই কোহিনূর তোমাকেই আমি উপহার হিসেবে দিচ্ছি। পিতার উপহার গ্রহণ করো।
বাবর লক্ষ করলেন হুমায়ূনের চোখ ছলছল করছে। এ-কী! এত অল্পতে তার ছেলের চোখে পানি আসছে কেন? একদিন সে সমস্ত ভারতবর্ষ শাসন করবে। পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে রাজদূতরা এসে তাকে কুর্নিশ করে বলবে, বাদশাহ নামদার। তাকে হতে হবে ইস্পাতের মতো কঠিন।
সম্রাট বাবরের দ্রু কুঞ্চিত হলো। তিনি উচু গলায় বললেন, পুত্র শোনো। শুধু এই হীরক খণ্ড না, ইব্রাহিম লোদীর রাজকোষের সম্পূর্ণ অর্থ আমি তোমাকে উপহার দিলাম। বলো, মারহাবা।
মারহাবা।
হুমায়ূন মীর্জা এর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন। সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর পিতার দিল্লীর কোষাগার দখন করে রাজকোষের সব অর্থ নিয়ে পালিয়ে গেলেন বাদাখশানের দিকে। আগস্ট মাস, ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দ। এই কাজ তিনি কেন করলেন তা এখন পর্যন্ত ঐতিহাসিকদের কাছে রহস্যাবৃত।
সম্রাট বাবর তার স্ত্রী মাহিম বেগমের সঙ্গে খেতে বসেছেন। সম্রাট খাচ্ছেন, মাহিম বেগম একটির পর একটি বাটি এগিয়ে দিচ্ছেন। সব খাবারই পরীক্ষা করা, তারপরেও স্বামীর পাত্রে খাবার দেওয়ার আগে নিজে চোখে দিচ্ছেন। বাবর বললেন, তোমার পুত্র যে আমার রাজকোষ লুট করে পালিয়ে গেছে এটা জানো?
জানি।
কাজটা সে কেন করেছে জানো?
জানি না।
তার কি শান্তি হওয়া উচিত?
উচিত। তবে আপনি দয়ালু পিতা। হুমায়ূন মীর্জা আপনার অতি আদরের প্রথম সন্তান।