কীভাবে?
শের খাঁ শান্ত গলায় বললেন, নানান খেয়ালে তিনি যেন সময় পার করতে পারেন আমরা সেই চেষ্টা করব। জাদুবিদ্যার একটা প্রাচীন বই জোগাড় করেছি। সেই বই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বইটি প্রাচীন কোনো অপ্রচলিত ভাষায় লেখা। সম্রাটের সময় যাবে বইটির ভাষা উদ্ধার করতে। আমি ত্রিপুরা রাজ্য থেকে একটা হাতির বাচ্চা জোগাড় করেছি। হাতির বাচ্চার বিশেষত্ব হচ্ছে—প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে সে দুটা শুঁড় নিয়ে জন্মেছে। সম্রাট দুই ওঁড়ের হাতির বাচ্চা নিয়েও সময় কাটাবেন। আমি কীভাবে শক্তি সংগ্ৰহ করছি তা তার চোখ এড়িয়ে যাবে।
সাইফ খাঁ বললেন, সম্রাট তো একা না। তার পরামর্শদাতারা আছেন। আমীররা আছেন, অতি বিচক্ষণ সেনাপতি বৈরাম খাঁ আছেন। এঁদের সবার চোখ আমরা কীভাবে এড়াব?
শের খাঁ অসহিষ্ণু গলায় বললেন, সম্রাট চোখ বুজলে তাঁর অনুসারীদেরও চোখ বুজতে হয় এটাই নিয়ম। সম্রাট এবং তাঁর অনুসারীদের বিভ্রান্ত করার জন্যে আমি কিছু কূটকৌশলের ব্যবস্থাও করেছি।
কী রকম?
আমি অতি দুর্বল একদল যোদ্ধাকে পাঠাব সম্রাটকে আক্রমণ করার জন্যে। তারা পরাজিত হবে। সম্রাটের ধারণা হবে শের খাঁ’র বাহিনী দুর্বল।
শের খাঁ’র প্রধান সেনাপতি ওসমান বললেন, কৌশলটা ভালো।
সম্রাটের কাছে আমি একটা পত্র পাঠাচ্ছি। এই পত্রেও আমার দুর্বলতা প্ৰকাশ পাবে।
জালাল খাঁ বললেন, কী পত্র পাঠাচ্ছেন আমরা কি শুনতে পারি? হ্যাঁ। পত্র আমি পড়ে শোনাচ্ছি।
হিন্দুস্থানের মালিক,
মহাপরাক্রমশালী সিংহহাদয় জ্ঞানতাপস মহান মোঘল সম্রাট বাদশাহ নামদার হুমায়ূন।
অধীন শের খাঁ’র বিনম সালাম গ্ৰহণ করুন।
আসসালামু আলায়কুম।
নিবেদন এই যে, বাদশাহর সম্মানে আমি দুটি সামান্য উপহার পাঠালাম।
দুই শুড়বিশিষ্ট একটি হস্তীশাবক, নাম হরিমতি। এইসঙ্গে জাদুবিদ্যার একটি প্রাচীন অপ্রচলিত ভাষায় রচিত গ্ৰন্থ। জাদুবিদ্যার প্রতি আপনার আগ্রহের কথা জেনেই এমন ক্ষুদ্র উপহার পাঠানোর সাহস করছি।
এখন আপনার প্রতি আমার সামান্য নিবেদন। অধীনের এই নিবেদন আপনি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন কি না তা আপনার বিবেচনা। মাঝে মাঝে বৃহৎবাপু হন্তীকেও সামান্য মুষিকের কথা শ্রবণ করা জরুরি হয়ে পড়ে।
চুনার দুর্গের পতনের পর আমার দুই বীরপুত্ৰ জালাল খাঁ এবং সাইফ খাঁ মানসিকভাবে বিপর্যন্ত। তারা প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। যে-কোনোদিন আমার এই দুই পুত্র আপনার সেনাবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এর ফলাফল শুভ না হওয়ার কথা। আমার এই দুই পুত্র অসীম সাহসী। প্রতিশোধ গ্রহণের উত্তেজনায় এই সাহস বহুগুণে বর্ধিত হয়েছে।
আমার পুত্রদের কাছে মোঘল বাহিনীর পরাজয় হলে হিন্দুস্থানের মালিক সম্রাট হুমায়ূনের জন্যে তা বিরাট কলঙ্ক। আমি সম্রাটকে এই কলঙ্কের বোঝা নিয়ে দিল্লী প্রস্থানের কথা চিন্তাও করি না। সম্রাটের কলঙ্ক তার দীন সেবক শের খাঁ’র কলঙ্ক।
এখন আমার অনুরোধ (এবং উপদেশ), আপনি অতি দ্রুত দিল্লীর দিকে যাত্রা করুন। আমি আমার ধৃষ্টতার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনাকে বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি, পুত্রদের উপর আমার তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। আপনি নিজে একজন মহাবীর, আপনি ভালোই জানেন বীররা নিয়ন্ত্রণ পছন্দ করে না।
বিনীত
সম্রাটের পদধূলিসম
শের খাঁ
শের খাঁ পত্র পাঠ শেষ করে দুই পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের কিছু বলার আছে?
জালাল খাঁ বললেন, আমরা দুই ভাইয়ের যে-কোনো একজন মোঘলদের সঙ্গে নকল যুদ্ধ করতে যাব এবং ইচ্ছাকৃতভাবে পরাজিত হব?
হ্যাঁ।
স্বেচ্ছা-পরাজয়ের ফলাফল হলো মোঘলদের হাতে বন্দি হওয়া। সে সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। মোঘলদের হতে বন্দি হওয়া মানে হাতির পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ।
এই কথাও ঠিক। বড় মঙ্গলের স্বার্থে ক্ষুদ্ৰ অমঙ্গল গ্রহণ করতে হয়।
সাইফ খাঁ বললেন, নকল যুদ্ধ করতে কে যাবে?
শের খাঁ বললেন, তুমি যাবে। মূল যুদ্ধে জালাল খাঁকে আমার প্রয়োজন। সে তোমার চেয়ে অনেকগুণ বিচক্ষণ যোদ্ধা।
সাইফ খাঁ বললেন, কবে যুদ্ধে যাব?
সম্রাট যেদিন এই পত্ৰ পাবেন তার সাত দিন পর।
প্রধান সেনাপতি ওসমান বললেন, আপনার দুই পুত্রের কাউকেই পাঠানোর প্রয়োজন নেই। আপনার সেনাপতিদের একজন যাবে।
শের খাঁ বললেন, তাতে আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। তবে সাইফ খা’র ভয়ের কোনো কারণ নেই। সে যদি ধরাও পড়ে তার পরিচয় পাওয়ার পর হুমায়ূন তাকে আমার কাছে সসম্মানে ফেরত পাঠাবেন। সম্রাট হুমায়ূনের চরিত্রের সবচেয়ে দুর্বল দিক হচ্ছে তার করুণা এবং ক্ষমা। আমরা তাঁর এই দুর্বলতা ব্যবহার করব।
শের খাঁ’র উপহার পেয়ে সম্রাট হুমায়ূন উত্তেজিত। জাদুর প্রাচীন বইটিকে স্বর্ণখনি বলে মনে হচ্ছে। তিনি ভাষা পড়তে পারছেন না, তবে বইয়ে অনেক ছবি। ছবিগুলি বইটির বিশেষত্ব বলে দিচ্ছে। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা মানুষের মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করা। তার পরের ছবিতে মুণ্ডু শরীরের সঙ্গে লাগানো। একটা ছবিতে মানুষের শরীরের সঙ্গে বিড়ালের মাথা লাগানো।
সম্রাট হিন্দুস্থানের বিভিন্ন ভাষার পণ্ডিতদের জড়ো করার নির্দেশ জারি করেছেন। তাদের কেউ-না-কেউ গ্রন্থের পাঠোদ্ধার করতে পারবে।
দুই ওঁড়ের হস্তীশাবক দেখেও তিনি উত্তেজিত। প্রকৃতির বিশেষ খেয়ালে এরকম একটি হস্তীশাবকের জন্ম হয়েছে, নাকি এটি বিশেষ কোনো প্ৰজাতির? বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।