সম্রাট বসেছেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। পরিবারের বাইরে আছে অম্বা, কিছু পরিচারিকা এবং একদল খোজা প্রহরী।
সম্রাট বললেন, খেলা দেখাও।
বাজিকর সম্রাটকে কুর্নিশ করল। এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল তার দুই হাতই খালি, এখন তার ডান হাতে একটা আমের আঁটি দেখা গেল। সে আমের আঁটি মাটিতে পুঁতে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাটি ফুড়ে আমগাছ বের হতে শুরু করল। সম্রাট বললেন, সোবাহানাল্লাহ।
বাজিকর গাছের উপর দিয়ে একবার হাত বুলিয়ে নিতেই দেখা গেল। গাছে তিনটা পাকা আম ঝুলছে। বাজিকর আম তিনটা ছিড়ে সম্রাটের সামনে রেখে আবারও কুর্নিশ করল। সম্রাট বললেন, মারহাবা। বলেই বিস্ময়ে অভিভূত হলেন-যেখানে আমগাছ ছিল সেখানে গাছ নেই। কুণ্ডলী পাকিয়ে বিষধর গোখরো সাপ বসে আছে। সাপ ফণা তুলেছে। ফোঁস ফোঁস শব্দ করছে।
মহিলারা অফুট শব্দ করে নড়েচড়ে বসলেন। জাদুকর মাথার পাগড়ি খুলে সাপ ঢেকে দিল। বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিতেই দেখা গেল পাগড়ির ভেতর কোনো সাপ নেই। সাপের পরম শত্রু লালচোখা বেজি বসে আছে। এবার সবাই একসঙ্গে বলল, মারহাবা।
সম্রাট বললেন, তুমি কি আমার সঙ্গে দিল্লী যাবে? আমি তোমাকে জয়গির দেব। বিশেষ বিশেষ উৎসবে তুমি তোমার খেলা দেখাবে। (সম্রাট কথা বললেন দোভাষীর মাধ্যমে, তিনি হিন্দুস্থানি জানেন না।)
জাদুকর বলল, না।
না কেন?
নদী অতিক্রম করা আমার জন্যে নিষেধ। নিষেধ কে করেছেন?
আমার গুরু।
জাদুকর গুরুর উদ্দেশে আকাশের দিকে তাকিয়ে দুই হাত জোড় করল। সম্রাট বললেন, জাদু দেখানোর সময় তুমি মন্ত্রপাঠ করেছ। মন্ত্র বলে কি কিছু আছে?
আছে।
সবচেয়ে কঠিন মন্ত্র কোনটি?
শূন্যে ভাসা মন্ত্র।
এই মন্ত্র পড়লে শূন্যে ভাসা যায়।
তুমি শূন্যে ভাসতে পার?
আমি পারি না, আমার গুরু পারেন।
জাদুকর আবারও গুরুর উদ্দেশে দুই হাত জোড় করল। তুমি কী পার? আমি পানির উপর হাঁটতে পারি। তবে নদীর পানি না, দিঘির শান্ত পানি। নদীর পানির উপর দিয়ে হাঁটা আমার গুরুর নিষেধ।
তুমি কি পানির উপর দিয়ে হাঁটার জাদু আমাকে দেখাতে পারবে?
পারব।
চিকিৎসক এবং সম্রাট এই দু’জনের কাছে সর্ব অবস্থায় সত্যি কথা বলতে হয়। তুমি সত্যি করে বলো, পানির উপর দিয়ে হাঁটার কি কোনো কৌশল আছে, না শুধুই মন্ত্র?
কৌশল আছে।
তুমি কি এই কৌশল আমাকে শিখাবে?
সম্রাট রাজ্য শাসন করবেন। ভোজবাজি কেন শিখবেন?
তুমি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পার। আমি তোমার ভোজবাজি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তুমি আমার কাছে কী চাও বলো।
আমি ভগবান ছাড়া কারও কাছে কিছু চাই না। আপনি আমার খেলা দেখে খুশি হয়েছেন এতেই আমি খুশি। সম্রাটকে খুশি করতে পারা বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি ভাগ্যবান।
সম্রাট তার কন্যা আকিকা বেগমকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। আকিকা ছুটে এল।
ভোজবাজির খেলা কেমন লাগল মা?
খুব ভালো লাগল বাবা।
এই জাদুকর আমাকে খুশি করেছে, আমি তাকে খুশি করতে চাই। কী উপহার পেলে সে খুশি এবং বিস্মিত হবে?
বাবা, আপনি তাকে একটা হাতি উপহার দিন।
হাতি?
হ্যাঁ হাতি। উপহার হিসেবে সে হাতি পাবে এটা কখনো কল্পনা করে নি। আপনার উপহার তার কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাবে।
তোমার সঙ্গে যে হিন্দুস্থানি মেয়েটি আছে সে কেমন আছে?
খুব ভালো আছে। আনন্দে আছে।
তার নাম যেন কী?
তার নাম অম্বা।
সে কি তার আত্মীয়স্বজনের কাছে ফেরত যেতে চায়?
না। আত্মীয়স্বজনরা তাকে ফেরত নেবে না। সে বাকি জীবন আমার সঙ্গে থাকবে। বাবা, আপনি কি জানেন আমরা দু’জন এক বিছানায় ঘুমাই?
জানতাম না। এখন জানলাম।
আপনি কি রাগ করেছেন?
আমি আমার আদরের আকিকা বেগমের উপর কখনো রাগ করব না।
আমি যদি কোনো অন্যায় করি তারপরেও না?
তারপরেও না। তুমি কি কোনো অন্যায় করেছ?
করেছি। বড় অন্যায় করেছি।
অন্যায়টা কি বলবো?
না।
আচ্ছা যাও। তোমার বড় অন্যায় ক্ষমা করা হলো।
সম্রাটের নির্দেশে হিন্দুস্থানি জাদুকরকে একটা হাতি উপহার দেওয়া হলো। হতভম্ব জাদুকর এবং তার মেয়েকে হাতির পিঠে চড়িয়ে দেওয়া হলো। বাচ্চা মেয়েটি আতঙ্কে অস্থির হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে থাকিল। (*হাতির পিঠে হিন্দুস্থানি জাদুকর এবং তার কন্যার মোঘল রীতিতে আঁকা একটি পেইন্টিং ব্রিটিশ জাদুঘরে রক্ষিত আছে।)
শের খাঁ তার সমরবিশারদদের নিয়ে গোপন বৈঠকে বসেছেন। সমরবিশারদদের চারজনের মধ্যে আছে তার দুই পুত্র জালাল খা, সাইফ খাঁ এবং দুই সেনাপতি।
শের খাঁ বললেন, যুদ্ধ শুরুর আগে শত্রুর সবল এবং দুর্বল দিকগুলি খুঁজে বের করতে হয়। সম্রাট হুমায়ূনের সবল এবং দুর্বল দিক কী?
জালাল খা বললেন, সম্রাট হুমায়ূন ভীরু মানুষ, এটাই তার দুর্বল দিক। তার কামানবাহিনী হলো তার সবল দিক।
পুত্র! তুমি ভুল বললে। হুমায়ূন অসম্ভব সাহসী একজন মানুষ। আমোদপ্রিয়, তবে সাহসী। আর তাঁর বিশাল কামানবাহিনী তাঁর সবচেয়ে দুর্বল দিক।
কেন? কামানবহর নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া যায় না। এত কামান কীভাবে দ্রুত টেনে নেবে? কামানবহরকে স্থির হয়ে এক জায়গায় থাকতে হয়। বিশাল কামানবহর নিয়ে আক্রমণ করা যায় না। শক্ৰ প্রতিরোধ করা যায়।
জালাল খাঁ বললেন, আমি এইভাবে ভাবি নি। আপনার কথা সত্য। তবে সম্রাট হুমায়ূন যে কাপুরুষ এই কথাটি সত্য।
তুমি মনে হয় পানিপথের যুদ্ধের কথা ভুলে গেছ। পানিপথে সম্রাট বাবরের ডানবাহুর দায়িত্বে ছিলেন হুমায়ূন। তিনি অসাধারণ বীরত্ব দেখিয়েছেন। বাহাদুর শাহ’র হাত থেকে তিনি চিতোর কীভাবে ছিনিয়ে নিয়েছেন তাও সম্ভবত তোমার মনে নেই। সম্রাট হুমায়ূন সাহসী, কিন্তু খেয়ালি মানুষ। তার চরিত্রের খেয়ালি অংশই হলো তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। আমরা তাঁর এই দুর্বলতাকেই ব্যবহার করব।