রুমী খাঁ বললেন, ঘটনা সত্য। আমি যা করেছি। মহান সম্রাটের নিরাপত্তার জন্য করেছি। যে সাড়ে তিন শ মানুষের দুই হাত কেটে ফেলা হয়েছে, এরা সবাই দুর্ধর্ষ কামানচি। এরা যেন আর কখনো সম্রাটের বাহিনীর উপর কামান চালাতে না পারে সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে। শক্রকে সমূলে বিনাশ করতে হয়।
হুমায়ূন বললেন, আপনাকে সাহসী মানুষ ভেবেছি। আপনি নিতান্তই কাপুরুষের মতো একটি কাজ করেছেন। আমি কাপুরুষ অপছন্দ করি।
যুদ্ধক্ষেত্রে কাপুরুষতা একটি সৎ গুণ। অনেক সময় কাপুরুষতা যুদ্ধজয়ে ভূমিকা রাখে।
সম্রাট বললেন, দুর্গের মানুষজন দুর্গ সমর্পণ করেছেন। কাজেই দুর্গ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল না। আপনি যে ভয়াবহ অন্যায় করেছেন, তার শাস্তি আপনারও দুই হাত কেটে নেওয়া।
উপস্থিত আমীরদের একজন বললেন, সম্রাটকে আমি তাঁর আদেশ পুনর্বিবেচনা করার জন্যে অনুরোধ করছি। সম্রাটের কামানবহর পরিচালনার দায়িত্ব রুমী খাঁর উপর। শের খাঁনের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধযাত্রা করব। যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ভর করবে। কামানের উপর। অর্থাৎ রুমী খাঁর নৈপুণ্যের উপর। যার রণকৌশলে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট তাকে মীর আতশ সম্মানে সম্মানিত করেছেন।
হুমায়ূন বললেন, যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ভর করে মহান আল্লাহপাকের ইচ্ছায়। কাপুরুষ রুমী খাঁর নৈপুণ্যে না। আগামীকাল ফজরের নামাজের পর মীর আতাশের দুই হাত কনুই থেকে কেটে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছি।
সম্রাট দরবার ছেড়ে উঠে পড়লেন। মাগরেবের নামাজের সময় হয়েছে। তিনি অজু করার জন্যে উঠে পড়লেন। রুমী খাঁকে গ্রেফতার করে তার তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হলো। রুমী খাঁ সেই রাতেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলেন।
অম্বার জায়গা হয়েছে হুমায়ূনের মেয়ে আকিকা বেগমের তাঁবুতে। অম্বা অতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে গেছে। একদিন আগের ঘটনার স্মৃতি কিছুই তার মনে নেই। অম্বা আকিকা বেগমের তাঁবুর জাকজমক দেখে হতভম্ব। চারজন খোজা প্রহরী সারাক্ষণ তাঁবু পাহারা দিচ্ছে। আকিকা বেগমের সেবায় নিযুক্ত আছে আটজন দাসী। দু’জন দাসীর হাতে ময়ুরের পালকে বানানো বিশাল পাখা। তারা সারাক্ষণই হাওয়া করছে।
আকিকা বেগম অম্বাকে খুবই পছন্দ করেছে। সে তার সঙ্গে পদ্ম ফুল পাতিয়েছে। আকিকা বেগম তার গলার নীলকান্তমণির মালা অম্বার গলায় পরিয়ে দিয়েছে। এখন চলছে। ধাঁধার আসর। ধাধার উত্তর যে দিতে পারবে না, তাকে সঙ্গে সঙ্গে নাকে মাটি ঘষতে হবে। দু’জনের হাতেই মাটির দলা।
আকিকা বলল, দিনে রাজপ্রসাদে থাকে রাতে থাকে জঙ্গলে, ফজরের ওয়াক্তে থাকে মাটির নিচে। এটা কী?
অম্বা বলল, জানি না।
আকিকা বলল, মাটি ঘষো।
অম্বা নাকে মাটি ঘষল।
আকিকা বলল, এখন তোমার পালা।
অম্বা বলল, তার এক শ’ চোখ। কিন্তু সে চোখে দেখে না।
আকিকা : এক শ’ চোখ কিন্তু চোখে দেখে না। আমি জানি না এটা কী।
এর নাম আনারস।
আনারস আবার কী? এক ধরনের ফল। বাঙ্গালমুলুকে পাওয়া যায়।
আকিকা বেগম আনারস ফল বাঙ্গালমুলুক থেকে আনার হুকুম দিল। ফল দেখার পর সে নাকে মাটি ঘষবে। আকিকা বেগমের নির্দেশে দু’জন অশ্বারোহী আনারসের সন্ধানে গেল। অম্বা হতভম্ব। বাচ্চা একটি মেয়ের এত ক্ষমতা!
শের খাঁ গোপন বৈঠকে বসেছেন। চুনার দুর্গ হাতছাড়া হওয়ায় তাকে মোটেই বিচলিত বলে মনে হচ্ছে না। শের খাঁ’র দুই পুত্র এবং তিনজন সেনাপতি বৈঠকে উপস্থিত। শের খাঁ বললেন, আমি নিশ্চিত সম্রাট হুমায়ূনকে আমরা পরাজিত করব। আমার পরিকল্পনা নির্ভুল। চুনার দুর্গ দখলের জন্যে হুমায়ূন ছয় মাস অপেক্ষা করেছেন। এই ছয় মাস আমি শক্তি সঞ্চয় করেছি। সম্রাটের প্রধান স্তম্ভ রুমী খাঁ গত। এটা আমাদের জন্যে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।
উপস্থিত সবাই বলল, মারহাবা।
শের খাঁ বললেন, এখানে উপস্থিত সবার প্রতি আমার একটি কঠিন নির্দেশ আছে। সম্রাট হুমায়ূনকে কোনো অবস্থাতেই হত্যা করা যাবে না।
শের খাঁর পুত্র জলাল খাঁ বললেন, কেন না?
শের খাঁ বললেন, হুমায়ূন আমার পরম শত্রু এটা সত্যি, কিন্তু তিনি এমন শক্র যাকে আমি শ্রদ্ধা এবং সম্মান করি। তিনি মহান মানুষদের একজন। এই মানুষটির অন্তর স্বর্ণখণ্ডের মতো উজ্জ্বল। সেখানে কলুষতার কণামাত্ৰও নাই।
শের খাঁ’র উজির বললেন, শক্ৰ সম্পর্কে এমন প্রশংসাসূচক বাক্য দুর্বলতার নামান্তর।
শের খাঁ বললেন, আমি অবশ্যই এই মানুষটির প্রতি দুর্বল। আমি সম্রাটের লেখা একটি কবিতা পাঠ করছি। পাঠ শেষ হওয়ামাত্র আপনারা বলবেন, মারহাবা।
অশ্ব অশ্বারোহীর বন্ধু নয়।
যেমন বন্ধু নয় বায়ু, মেঘমালার।
বন্ধু হবে এমন যাদের সঙ্গে কখনো দেখা হবে না।
দু’জনই থাকবে দু’জনের কাছে অদৃশ্য।
দৃশ্যমান থাকবে তাদের ভালোবাসা।
শের খাঁ’র উজির নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে বললেন, মারহাবা।
হিন্দুস্থানি এক নগ্নগাত্র জাদুকর
হিন্দুস্থানি এক নগ্নগাত্র জাদুকর এসেছে সম্রাটকে ভোজবাজি দেখাতে। তার কোমরের কাছে মালকোঁচা দিয়ে পরা নোংরা ধুতি। মাথায় বিশাল সাদা পাগড়ি। পাগড়ি পরিষ্কার, ঝকঝক করছে। সে কৃশকায়, গাত্রবর্ণ পাতিলের তলার মতো কালো। ভোজওয়ালার সঙ্গে তার কন্যা। বয়স চার-পাচ। সেও নগ্নগাত্র। লাল টুকটুকে প্যান্ট পরেছে। মেয়েটির চোখ মায়াকাড়া। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্রাটের দিকে। একবারের জন্যেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছে না। তার দৃষ্টিতে ভয় এবং বিস্ময়।