সতীদাহ হবে আলামপনা। মৃত স্বামীর সঙ্গে ভূরী জীবিত স্ত্রীকে চিতায় পোড়ানো হবে।
এই সেই সতীদাহ! আমি সতীদাহের কথা শুনেছি, আগে কখনো দেখি নি।
দেখার জিনিস না। হিন্দুস্থানি বর্বরতা চলুন ফিরে যাই।
যে মেয়েটিকে পুড়িয়ে মারা হবে তাঁর সঙ্গে কি কথা বলা যাবে?
আলামপনা। সে কথা বলার মতো অবস্থায় এখন থাকবে না। সবাই তাকে ঘিরে আছে। তাকে নিশ্চয়ই আরক খাওয়ানো হয়েছে। সে এখন নেশাগ্রস্ত।
একদল মানুষ দেখছি লাঠিসোটা নিয়ে দাঁড়িয়ে। এরা কারা?
সবসময় দেখা গেছে আগুন লাগানোমাত্র সতী দৌড় দিয়ে চিতা থেকে পালাতে চায়। তখন লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাকে চিতায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং আগুনের উপর মেয়েটিকে চেপে ধরে রাখা হয়।
নরকের বর্বরতা।
অবশ্যই।
আমি এই মুহুর্তে ফরমান জারি করে সতীদাহ বন্ধ করতে চাই।
আলামপনা। গুস্তাকি মাফ হয়। আপনার সমস্ত প্ৰজা হিন্দু। আপনি ওদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে বাধা দিলে তারা বৈরী হয়ে উঠবে। আপনার জন্যে শাসনকার্য পরিচালনা দুষ্কর হবে।
আমি মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে চাই।
ঘোড়ার ব্যবসায়ী হিসেবে তারা আপনার সঙ্গে মেয়েটিকে কথা বলতে দেবে না।
তাদেরকে তুমি বলো আমি মোঘল সম্রাট হুমায়ূন এবং আমার রক্ষীবাহিনীকে কাছে এগিয়ে আসতে বলো।
চিতায় ঘিয়ের আগুন জ্বলে উঠেছে। সেখানে প্রায় সত্তর বছর বয়সী। এক চুলপাকা বৃদ্ধের শবদেহ। তার চুলে আগুন ধরতেই নিমিষে সব চুল জ্বলে গেল। আগুন ভালোমতো জ্বলে উঠলে সতী স্বেচ্ছায় হেঁটে হেঁটে চিতায় উঠবে। তাকে ভাং-এর শরবত খাওয়ানো হয়েছে। তার চিন্তাশক্তি কাজ করছে না। ঢোলের বাদ্য আকাশ স্পর্শ করছে। শশানঘরের তরুণীরা একে একে আসছে। সতী মেয়েটির কপালে সিঁদুর দিচ্ছে। সেই সিঁদুর নিজের কপালে ঘষছে এবং উপুড় হয়ে পড়ে মেয়ের পায়ে পড়ে তাকে প্ৰণাম করছে। বাজনাদাররা আধাপাগলের মতো নাচছে। হঠাৎ বাদ্যবাজনা থামল। সম্রাট হুমায়ূন এগিয়ে এলেন।
তাঁর ঘোড়া এসে থামল সতীদাহের মেয়েটির সামনে। বারো-তের বছর বয়সী একটি মেয়ে। পরনে লালপোড়ে শাড়ি। গা-ভর্তি অলংকার। কী সুন্দর সরল মুখ, বড় বড় চোখ! ভয়ে আতঙ্কে সে থরথর করে কাঁপছে। মেয়েটির সঙ্গে কোথায় যেন সম্রাটের কন্যা আকিকা বেগমের মিল আছে।
তোমার নাম কী? বলো, নাম বলো।
অম্বা।
তোমার স্বামী মারা গেছে। সে চিতায় পুড়ে কয়লা হবে। তুমি তো বেঁচে আছ, তুমি কেন মরবে?
অম্বার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সে ক্ষীণস্বরে বলল, আমি মরতে চাই না। এরা আমাকে মেরে ফেলবে।
সম্রাট ঘোড়া থেকে নামলেন। অম্বার কাছে এগিয়ে গেলেন। গলা নিচু করে বললেন, আমি নিজের হাতে তোমাকে পানি খেতে দেব। তুমি বিসমিল্লাহ বলে সেই পানি খাবে। মনে থাকবে?
অম্বা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। সে খানিকটা হকচকিয়ে গেছে। মেয়েটির আত্মীয়স্বজন এবং জড়ো হওয়া লোকজন এগিয়ে আসতে চাচ্ছে কিন্তু সম্রাটের রক্ষীবাহিনীর কারণে কাছে আসতে পারছে না। তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। হুমায়ূন তাদের দিকে তাকিয়ে গলা উঁচু করে বললেন, অম্বা নামের এই মেয়েটা এইমাত্র আমার হাতে বিসমিল্লাহ বলে পানি খেয়েছে। বিধর্মীর হাতে পানি খাওয়ার কারণে তার জাত গেছে। বিসমিল্লাহ বলায় মেয়েটি মুসলমান হয়ে গেছে। আমার আইনে কোনো মুসলমান মেয়েকে সতী হিসেবে দাহ করা যাবে না।
সম্রাট হুমায়ূন অম্বাকে নিয়ে শিবিরের দিকে রওনা হলেন। মাতাল ডোমের দল লাঠিসোটা নিয়ে পিছন পিছন ছুটল। তাদের সঙ্গে পুরোহিতের দল। বাজনাদারদের দল। মহিলাদের দল। ‘সতী’ কন্যাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে—এ হতে দেওয়া যায় না।
সম্রাটের নির্দেশে তীরন্দাজরা তীর ছুঁড়ল। অব্যৰ্থ তীরের আঘাতে চারজন পুরোহিতের তিনজনই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হতভম্ব দল উল্টাদিকে দৌড়াতে শুরু করল।
মাগরেবের নামাজের শেষে সম্রাট দরবার বসিয়েছেন। চুনার দুর্গ দখলে এসেছে। দুর্গের দায়িত্ব কাকে দেওয়া হবে সেই বিষয়ে পরামর্শসভা বসেছে। বাংলামুলুক অভিযানে কখন রওনা হতে হবে—সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আজকের সভা গুরুত্বপূর্ণ। আমীররা সবাই উপস্থিত। রুমী খাঁ, (মীর আতশ) উপস্থিত। দরবারে খাসের নিয়ম ভঙ্গ করে চারজন নর্তকী উপস্থিত। এদেরকে আনা হয়েছে চুনার দুর্গ থেকে। গুরুত্বপূর্ণ সভায় নর্তকীরা কখনোই উপস্থিত থাকে না। আজ তারা কেন উপস্থিত বোঝা যাচ্ছে না। নর্তকীরা ভীতসন্তস্ত্ৰ। তারা মাথা নিচু করে আছে। কিছুক্ষণ পরপর একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। একজন গোপনে অশ্রুবর্ষণ করছে।
সম্রাট চুনার দুর্গ দখলে আসার কারণে আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। সবাই বলল, আমীন।
আমীর বেগ মীরেক-কে চুনার দুর্গের গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হলো। সবাই বলল, অতি উত্তম সিদ্ধান্ত।
সম্রাট সবাইকে ভোজসভায় আহবান জানালেন। মীর আতশ বললেন, অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং গোপন মিটিংয়ে নর্তকীরা উপস্থিত। এর কারণ বুঝতে পারছি না।
সম্রাট বললেন, এরা আমার কাছে একটা অভিযোগ করেছে। অভিযোগ গুরুতর। আমার ধারণা অভিযোগ মিথ্যা। যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট করে এদের হত্যা করা হবে।
বৈরাম খাঁ বললেন, অভিযোগ কী?
হুমায়ূন বললেন, অভিযোগ হচ্ছে রুমী খাঁ দুর্গে প্রবেশের পরপর সাড়ে তিন শ মানুষের দুই হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশ সঙ্গে সঙ্গে পালন করা হয়েছে। রুমী খাঁ, এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?