পশ্চিম আকাশের মেঘ পরিষ্কার হচ্ছে না, বরং গাঢ় হচ্ছে। ঘন কালো মেঘের যে বিচিত্র সৌন্দর্য আছে তা হুমায়ূন আগে লক্ষ করেন নি। আকাশের এই ছবি এঁকে ফেলতে পারলে ভালো হতো। তার ছবি আঁকার হাত এখনো সেই পর্যায়ে আসে নি। আফসোস!
আলামপনা!
হুমায়ূন পেছনে তাকালেন। জওহর আবাতাবচি (আবতাব শব্দের অর্থ পানি। আবতাবচি—যে পানি সরবরাহ করে। সম্রাটকে পানি খাওয়ানোর দায়িত্ব জওহর আবিতাবচি’র।) সম্রাটের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি।
জওহর! সুপ্ৰভাত।
জওহর লজ্জায় মাথা নিচু করল। সে কিছু বলার আগেই সম্রাট তাকে সুপ্ৰভাত জানালেন। কী লজ্জা! কী লজ্জা!
জওহর আমতা আমতা করে বলল, সুপ্ৰভাত মহান সম্রাট। আমি আপনার জন্যে সুসংবাদ নিয়ে এসেছি। কিছুক্ষণ আগে রুমী খাঁ দলবল নিয়ে চুনার দুর্গে প্রবেশ করেছে। শের খাঁ’র ছেলে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আমার হৃদয় এই মুহুর্তে আনন্দে পূর্ণ। আমার কাছে তুমি কী উপহার প্রার্থনা করা?
আপনার স্নেহ। আল্লাহপাক সাক্ষী, আপনার স্নেহ এবং করুণা ছাড়া আমার আর কিছুই চাইবার নেই। আমি আমৃত্যু আপনাকে পানি খাইয়ে যেতে চাই।
তা-ই হবে। আমি দু’টি রাজকীয় ফরমান জারি করব। কলমচিকে আসতে বলো।
রাজকীয় ফরমানের প্রথমটিতে লেখা হলো, জওহর আবিতাবচি আজীবন সম্রাটকে পানি খাওয়ানোর দায়িত্বে থাকবে। তাকে এক হাজারি মসনদদারি দেওয়া হলো।
দ্বিতীয় ফরমানে রুমী খাঁকে মীর আতশ উপাধি দেওয়া হলো। তাকে চুনার দুর্গের আপাতত দায়িত্ব দেওয়া হলো। দুর্গের বন্দিদের যেন প্রাণহানি না হয়। সম্রাট দুর্গের প্রতিটি বন্দির প্রাণের জিম্মাদার।
ফরমানজারির পর হুমায়ূন এক পেয়ালা বেদানার রস খেলেন। অজু করে আল্লাহপাকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে সূরা ফাতেহা পাঠ করলেন। জওহর সারাক্ষণই সম্রাটের পাশে বসে রইল।
জওহর।
জি আলামপনা।
আমি ছদ্মবেশে কিছুক্ষণের জন্যে শহর ঘুরতে বের হব। হযরত ওমর রাজিআল্লাহুতালা আনহু এই কাজ করতেন।
উনি রাতে বের হতেন। দিনে না।
রাতের আলোয় কিছুই দেখা যাবে না। আমি দিনের আলোয় বের হব। তুমি আমাকে ঘোড়া ব্যবসায়ীর মতো সাজিয়ে দাও। চাদরে আমার ঠোঁট থাকবে ঢাকা। মানুষের পরিচয় লেখা থাকে ঠোঁটে। ঠোঁট ঢাকা মানুষ হলো পরিচয়হীন মানুষ।
পাশাপাশি দুটি ঘোড়া চলছে। একটিতে সম্রাট হুমায়ূন অন্যটিতে জওহর আবিতাবচি। অনেক দূর থেকে তাদেরকে অনুসরণ করছে সম্রাটের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনী। তেমন প্রয়োজনে নিমিষের মধ্যে ছুটে এসে তারা সম্রাটকে ঘিরে ফেলবে। ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ালেও সম্রাটের নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা নেই।
শহর শান্ত। দোকানপাট খুলেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। চুনার দুর্গ পতনের কোনো প্রভাব শহরে পড়ে নি। শহরের কেন্দ্রে হরিসংকীর্তন হচ্ছে। সেখানে ছেলেবুড়ো ভিড় করেছে। সম্রাট কিছুক্ষণ হরিসংকীর্তন শুনলেন।
একজন নাগা সন্ন্যাসীকে দেখা গেল। গায়ে ভস্ম মেখে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় ঘুরছে। তাকে ঘিরে একদল ছেলেমেয়ে। নাগা সন্ন্যাসী তার সাধনদণ্ডে কাসার একটি ঘণ্টা ঝুলিয়ে দিয়েছে। যখন সে হাঁটছে ঘণ্টায় ঢং ঢেং শব্দ হচ্ছে। সম্রাট নাগা সন্ন্যাসীর সঙ্গে জওহর আবিতাবিচির মাধ্যমে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তিনি হিন্দুস্থানি ভাষা জানেন না।
আপনি নগ্ন ঘুরছেন কেন?
আমি নাগা সন্ন্যাসী, সবকিছু বিসর্জন দিয়েছি বলেই নগ্ন।
আপনি তো লজ্জাও বিসর্জন দিয়েছেন। লজ্জা বিসর্জনের জিনিস না।
তোর কাছে না, আমার কাছে লজ্জাও বিসর্জনের।
আপনি গোপন অঙ্গে ঘণ্টা বেঁধেছেন কেন?
সবাইকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্যেই ঘণ্টা।
আপনি তো সবই বিসর্জন দিয়েছেন। গোপন অঙ্গও বিসর্জন দিন। এর তো আপনার প্রয়োজন নেই।
আমাকে নিয়ে তুই মাথা ঘামাচ্ছিস কী জন্যে? তুই ঘোড়া বেচাতে এসেছিস, ঘোড়া বিক্রি কর। পুণ্য কামাতে চাইলে আমার সেবা কর।
সম্রাট তাকে দশটা তাম্রমুদ্রা দিয়ে শহরের বাইরে চলে গেলেন। নদীর পাড় ঘেঁসে ঘেঁসে যাচ্ছেন। তার অদ্ভুত লাগছে। মধুর বাতাস। পশ্চিম আকাশের মেঘ এখন ভেলার মতো পুরো আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে। একটা তালগাছ বাঁকা হয়ে নদীর দিকে ঝুঁকে আছে। একদল শিশু তালগাছে উঠে সাবধানে মাথা পর্যন্ত যাচ্ছে, সেখান থেকে ঝাপ দিয়ে নদীতে পড়ছে। তাদের কী আনন্দ! সম্রাট বললেন, দেখো জওহর। ওদের কী আনন্দ!
জওহর কিছু বলল না। হুমায়ূন বললেন, সম্রাটের পুত্র-কন্যারা এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত।
জওহর বলল, তাঁদের জন্য অন্য আনন্দ। মহান আল্লাহ ঠিক করে রেখেছেন কে কী আনন্দ পাবে। সম্রাট বললেন, চলো এগুই। আরও কোনো আনন্দদৃশ্য হয়তো সামনেই আছে।
সম্রাট এগুলেন। প্রায় দু’ক্রোশ এগুবার পর তিনি থমকে দীড়ালেন। সামনে নলখাগড়ায় ঢাকা শ্মশানঘাট। বৃষ্টির সময় আশ্রয় নেওয়ার জন্যে চারদিক খোলা শ্মশানবন্ধু ঘর। ঘর ভর্তি নানান বয়সী। নারী। তারা কলকল করে কথা বলছে।
চারদিক লোকে লোকারণ্য। ঢোল বাজছে, কাঁসার ঘণ্টা বাজছে। কিছুক্ষণ পরপর সবাই মিলে গগনবিদারী চিৎকার দিচ্ছে—সতী মাই কি জয়।
চারজন পুরোহিত আসন করে বসে আছে। মন্ত্রপাঠ চলছে। পুরোহিতদের দক্ষিণ দিকে নদীর কাছাকাছি ডোমরা বসেছে কলসিভর্তি চোলাই মদ নিয়ে। তাদের চোখ রক্তবর্ণ।
সম্রাট বিস্মিত হয়ে বললেন, কী হচ্ছে?