প্রথম যাত্রাবিরতিতে সম্রাটকে যে খাবার দেওয়া হয়েছিল, তার বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে।
পোলাও : পাঁচ ধরনের।
রুটি : সাত প্রকারের।
পাখির মাংস : কিসমিসের রসে ভেজানো পাখি ঘিতে ভেজে দেওয়া।
পাখিদের মধ্যে আছে হরিয়াল, বনমোরগ, বিশেষ শ্রেণীর ময়ূর।
ভেড়ার মাংস : আস্ত ভেড়ার রোষ্ট।
বাছুরের মাংস : কাবাব।
পাহাড়ি ছাগের মাংস : আস্ত রোস্ট (সম্রাটের বিশেষ পছন্দের খাবার)।
ফল, শরবত, মিষ্টান্ন।
সম্রাট হুমায়ূন এবং তাঁর পরিবারের জন্যে যুদ্ধকালীন বাবুর্চির সংখ্যা ছিল এক হাজার। প্রধান বাবুর্চি নকি খান নতুন নতুন খাবার উদ্ভাবন করতেন। তাঁর উদ্ভাবিত একটি খাবার পুরনো ঢাকার কিছু রেস্তোরায় এখনো পাওয়া যায়। খাবারের নাম গ্লাসি।
গ্লাসির রেসিপি (মোঘল আমলের) দেওয়া হলো। পাতলা স্লাইস করে কাটা খাসির মাংস সজারুর কাঁটা (বিকল্প, খেজ্বরের কাটা) দিয়ে কেঁচতে হবে। কেঁচানো মাংসে দিতে হবে কিসমিচের রস, পোস্তদানা বাটা, পেস্তা বাটা, শাহী জিরা বাটা, আদার রস, পেঁয়াজের রস, রসুনের রস, দই, দুধ এবং গম বাটা। পরিমাণমতো লবণ। এতে যুক্ত হবে জয়ত্রি গুড়া, জায়ফল গুড়া, দারুচিনি গুড়া। সব ভালোমতো মেখে মাটির হাঁড়িতে রেখে ঢাকনা লাগিয়ে দিতে হবে। মাটির হাঁড়ি সারা দিন রোদে থাকবে। খাবার পরিবেশনের আগে আগে অল্প আঁচে মাংসের টুকরা মহিষের দুধের ঘিতে (ভৈসা ঘি) ভাজতে হবে।
বঙ্গদেশের দিকে যাত্রার সময় তাঁর রসদখানায় মহিষের দুধের ঘি ছিল দশ মণ এবং গরুর দুধের ঘি ছিল ত্রিশ মণ।
সৈন্যদের খাবার ছিল : এক ঘটি দুধ, যবের রুটি, এক পোয়া ছাতু, মাংস এবং পেঁয়াজ।
যাত্রাবিরতির প্রথম রাত্ৰি।
হুমায়ূন এশার নামাজ শেষ করে তাঁর জন্যে খাটানো চৌবনরৌতি তাঁবুতে গেছেন। গানবাজনা শুনে আফিং খেয়ে ঘুমাবেন।
তাঁর নিজস্ব ভৃত্য জওহর আবিতাবচি তাঁকে জানাল শের খাঁ তাঁর জন্যে কিছু উপহার পাঠিয়েছেন। উপহারের মধ্যে আছে তিনজন অতি রূপবতী বাঙ্গালমুলুকের তরুণী এবং সাতজন হিজড়া। উপহারের সঙ্গে একটি পত্রও আছে।
সম্রাট পত্র পাঠ করলেন। শের খাঁ লিখেছেন—
দিল্লীশ্বর সম্রাট হুমায়ূন,
আপনি অধম তুচ্ছতিতুচ্ছ শের খাঁকে শায়েস্তা করতে যাচ্ছেন। আমি আপনার দাসানুদাস। আমার কারণে এই তীব্ৰ গরমে আপনার কষ্ট হচ্ছে, এটা আমি নিতেই পারছি না।
আপনি দিল্লীতে ফিরে যান।
আপনাকে চুনার দুর্গ আমি দিয়ে দিচ্ছি।
কিছু উপহার পাঠালাম। আমি জানি উপহার আপনার পছন্দ হবে।
ইতি
অধম শের খাঁ (ফরিদ)
চিঠিতে কাজ হলো। সম্রাট নির্দেশ দিলেন, একদিন বিশ্রামের পর মূল সেনাবাহিনী দিল্লী ফেরত যাবে। ডেকে পাঠানো হবে শের খাঁকে। চুনার দুর্গের দখল নেওয়ার জন্যে রুমী খাঁকে পাঠানো হবে। রুমী খাঁর নেতৃত্বে থাকবে বেশ কিছু কামান এবং দুই শ কামানচি। কামানের প্রয়োজন হবে না। তারপরেও থাকল।
ফজরের নামাজের পর দিল্লী যাত্রা শুরু হবে। নামাজের পরপর হুমায়ূন ঘোষণা করলেন চুনার দুর্গ হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় তিনি উপস্থিত থাকতে চান। কাজেই যুদ্ধযাত্রা অব্যাহত থাকবে। সম্রাটের খামখেয়ালির সঙ্গে তার সেনাপতি এবং আমীররা পরিচিত। কেউ অবাক হলেন না।
চুনার দুর্গের অধিনায়ক শের খাঁ’র পুত্র কুতুব খাঁ।
চুনার দুর্গে পৌঁছতে হুমায়ূনের চার মাস সময় লাগল। তিনি নভেম্বরে পৌঁছলেন। আরামদায়ক আবহাওয়ায় হুমায়ূন প্রসন্ন। ভেষজবিদ্যার উপর কিছু দুর্লভ বই তার কাছে এসেছে। বইয়ে বর্ণিত গাছের গুণাগুণ পরীক্ষার বাসনায় তিনি অস্থির। দুর্গ দখলের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্ব শুরু করবেন।
দুর্গের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার জন্য কুতুব খাঁর কাছে দূত গেল। কুতুব খাঁ বললেন, সম্রাট স্বয়ং উপস্থিত হলেই দুর্গ তার হাতে তুলে দেওয়া হবে।
সম্রাটের দূত বললেন, সামান্য দুর্গ দখলের জন্যে হিন্দুস্থানের অধিপতির আসা শোভা পায় না।
কুতুব খাঁ বললেন, হিন্দুস্থানের অধিপতিকে অনেক তুচ্ছ কাজ কিন্তু করতে হয়। শব্দ করে তিনি বায়ু ত্যাগ করেন। আপনি হয়তো শোনেন নি।
আপনার ঔদ্ধত্যমূলক আচরণের সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।
শুনে খুশি হলাম। আফগানরা সমুচিত জবাব ভালোবাসে।
আপনি যে নোংরা কথাগুলি বলেছেন আমি নিজে সম্রাটকে তা জানাব।
সেই সুযোগ আপনি পাবেন না।
এই কথার অর্থ কী?
আপনাকে বাধ্য করা হবে সম্রাটকে একটা পত্ৰ পাঠাতে। সেই পত্রে আপনি বিনয়ের সঙ্গে লিখবেন যে, আপনি স্বেচ্ছায় দলত্যাগ করে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।
জীবন থাকতে এ ধরনের চিঠি আমি লিখব না।
জীবন থাকা অবস্থাতেই আপনি লিখবেন। আমার নির্দেশে আপনাকে খোজা করানো হবে। খোজা করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ামাত্রই আপনি চিঠি লিখতে রাজি হবেন।
সম্রাট হুমায়ূন তাঁর দূতের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলেন। চিঠিতে জানলেন এই আমীর দলত্যাগ করেছে। তাঁর শক্তি ও সামথ্য সে ব্যয় করবে। আফগানদের জন্যে।
হতভম্ব সম্রাট রুমী খাঁ-কে দুর্গ দখলের নির্দেশ দিলেন। রুমী খাঁ কামান দাগতে শুরু করলেন। এর উত্তরে কুতুব খাঁ’র দুর্গের ভেতর থেকে কামানের গোলা বৃষ্টির মতো পড়তে শুরু করল। কুতুব খাঁ’র কামানগুলি ছোট। তবে তাদের নিশানা অব্যৰ্থ। রুমী খাঁ-কে পেছনে হটতে হলো।
মোঘল সৈন্যরা দুর্গ অবরোধ করে পাঁচ মাস বসে রইল। দুর্গ দখল করতে পারল না। এর মধ্যে শুরু হলো বঙ্গের বিখ্যাত বৃষ্টি।
দোতলা তাঁবু
সম্রাট হুমায়ূন দোতলা তাঁবুর (ডুরসানা মঞ্জেল) বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টি পশ্চিমের দিগন্তরেখায়। ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে। সূর্য এখনো পুরোপুরি ওঠে নি। পশ্চিম আকাশে মেঘের ঘনঘটা। সম্রাট প্রথম সূর্যকিরণ কপালে মাখতে চাচ্ছেন। এই মুহূর্তে হুমায়ূনের সৌভাগ্যের ঘাটতি যাচ্ছে। ছয় মাস পার হয়েছে, চুনার দুর্গ দখল হয় নি। গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান মীর আতশ পুরোপুরি ব্যৰ্থ। সে নৌকায় কামান বসিয়ে কামান দাগার হাস্যকর চেষ্টা করেছিল। কামান দাগামাত্র গোলার প্রবল বিপরীত ধাক্কায় দুটি বড় নৌকা কামান এবং বারুদসহ পানিতে ড়ুবে গেছে। কামানের সঙ্গে তিনজন কামানচিও পানিতে। তারা সাঁতার না জানার কারণে পানির নিচ থেকে উঠে আসতে পারে নি।