আমার বহরের সঙ্গে তোমার অতি আদরের ভগ্নি গুলবদন থাকবে। সে তোমার সাক্ষাতের জন্যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছে। প্রিয় ভ্রাতা, তোমার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে আমি একটি নীলা এবং একটি পোখরাজ পাঠালাম। তুমি রত্ন দু’টিকে প্রতিদিন দুগ্ধমান করাবে। এর অন্যথা হলে রত্নের ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হবে। এখন তাৎক্ষণিকভাবে তোমার উদ্দেশে রচিত পঞ্চপদী–
কামরান
চন্দ্ৰ প্ৰস্ফুটিত তার দু’নয়ন।
হৃদয় আর্দ্র আবেগে
যার কেন্দ্ৰে তার ভাই
মীর্জা হুমায়ূন।
কামরান মীর্জা পত্রের জবাব দিলেন না। তার দরবারের এক আমীরকে সম্রাটের কাছে পাঠালেন। আমীর সম্রাট হুমায়ূনকে জানালেন, পাঁচটি কারণে কামরান মীর্জা তাঁর সঙ্গে যেতে পারছেন না।
১. তিনি অসুস্থ। পেটের পীড়ায় ভুগছেন।
২. তাঁর প্রধান গণক গণনা করে পেয়েছে, যুদ্ধযাত্রায় তার প্ৰাণনাশের সম্ভাবনা।
৩. লাহোর অরক্ষিত রেখে রওনা হওয়ার অর্থ শত্রুর হাতে লাহোর তুলে দেওয়া।
৪. স্বপ্লে তিনি তাঁর পিতা সম্রাট বাবরকে দেখেছেন। সম্রাট বাবর তাকে লাহোর ছেড়ে যেতে নিষেধ করেছেন।
৫. তাঁর প্রিয় ঘোড়া লালী মারা গিয়েছে। তিনি ভালো ঘোড়ার সন্ধানে আছেন। শিক্ষিত এবং পরিচিত ঘোড়া ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়া যায় না।
আমার সঙ্গে না যাওয়ার পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছে। একটি কারণই যথেষ্ট ছিল। পাঁচটি কারণের একটিতে সে আমার মহান পিতাকে টেনে এনেছে। তার প্রয়োজন ছিল না। আপনি আমার ভাইকে বলবেন, যা ঘটবে আল্লাহ্পাকের হুকুমেই ঘটবে। আমি কামরান মীর্জার জন্যে একটি শিক্ষিত আরবি ঘোড়া আপনার সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি। পেটের পীড়া একটি নোংরা ব্যাধি। আমি দ্রুত তার আরোগ্য কামনা করছি।
সম্রাটের নির্দেশে আমীরকে একপ্রস্থ পোশাক, একটি রত্নখচিত তরবারি, দশটা আশরাফি দেওয়া হলো। ভাইয়ের পাঠানো দূতের প্রতি সম্মান দেখানো হলো। এই আমীরের নাম মীর হামজা।
মীর হামজা লাহোর ফিরছেন। তার সঙ্গে বিশজন অশ্বারোহীর একটি ক্ষুদ্র দল। রসদ বহনকারী একটা ঘোড়ার গাড়ি। এই গাড়ির সঙ্গেই কামরান মীর্জাকে দেওয়া সম্রাট হুমায়ূনের আরবি ঘোড়া বাধা। ঘোড়ার রঙ সাদা। তার নাম ফাতিন। ফাতিন শব্দের অর্থ সুন্দর।
বিশ ক্রোশ অতিক্রম করার পর মীর হামজাকে থামতে হলো। অশ্বারোহী বিশাল বাহিনী নিয়ে বৈরাম খাঁ দাঁড়িয়ে আছেন। বৈরাম খাঁ বললেন, সম্মানিত আমীর মীর হামজা! আপনার সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।
মীর হামজা বললেন, অশ্বারোহী বিশাল বাহিনী নিয়ে একান্তে কথা?
আমরা দুজন দূরে সরে যাব। একান্ত কথা সেখানেই হবে।
আপনি আপনার বাহিনী নিয়ে এসেছেন কেন?
বৈরাম খাঁ হাসতে হাসতে বললেন, গাধার বেপারি সঙ্গে গাধা নিয়ে চলাফেরা করে। গাধাগুলি হচ্ছে তার শোভা। একজন সেনাপতির শোভা তার সৈন্যবাহিনী।
আমি আপনার সঙ্গে একান্তে কথা বলব না। যা বলতে চান। এখানে বলুন।
আমার সম্রাটের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে। সম্রাটকে আপনার কেমন মনে হয়েছে?
তিনি ভীতুপ্রকৃতির মানুষ।
ভীতু?
হ্যাঁ ভীতু৷ ভীতু বলেই ভাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করছেন।
ভ্ৰাতৃস্নেহও তো হতে পারে। সম্রাটদের ভ্রাতৃস্নেহ থাকে না। ভ্রাতৃভীতি থাকে।
সম্রাট হুমায়ূন যুদ্ধযাত্রার পরপর কি কামরান মীর্জা নিজেকে দিল্লীর সম্রাট ঘোষণা করবেন?
সেটা উনিই ভালো বলতে পারবেন। আমি অন্তর্যামী না।
আমি এই তথ্য বিশেষভাবে জানতে চাচ্ছি। সম্রাটের অমঙ্গল আশঙ্কায় আমি অস্থির।
মীর হামজা বললেন, আপনাকে আগেই বলেছি আমি অন্তর্যামী না। কামরান মীর্জার পরিকল্পনা আমি জানি না।
বৈরাম খাঁ বললেন, আমি কামরান মীর্জার পরিকল্পনা আঁচ করতে পারছি। আপনি এই খবর কামরান মীর্জাকে জানাবেন।
অবশ্যই জানানো হবে।
বৈরাম খাঁ বললেন, আপনাকে মুখে কিছু জানাতে হবে না। আমি এমন ব্যবস্থা করব যে আপনি লাহোরে উপস্থিত হওয়ামাত্ৰ কামরান মীর্জা যা বোঝার বুঝে নেবেন।
কী ব্যবস্থা করবেন?
আপনার জন্যে একটি গাধা সংগ্ৰহ করা হয়েছে। আপনি গাধার পিঠে চড়ে লাহোরে যাবেন। নগ্ন অবস্থায় যাবেন।
আপনি উন্মাদের মতো কথা বলছেন।
হতে পারে। আপনার সঙ্গের অশ্বারোহীরা আমার সেনাবাহিনীতে যোগ দিবে। এরা ভাড়াটিয়া সৈন্য। দলত্যাগে তাদের কখনো সমস্যা হয় না।
সম্রাট হুমায়ূনের কানে এই খবর পৌঁছানোর পরিণাম হবে ভয়াবহ।
তার কানে এই খবর আমিই পৌঁছোব। তাকে বলব, মীর হামজা লাহোরের পথে রওনা হওয়ার পর একদল ডাকাতের হাতে পড়েন। ডাকাতরা তাঁর সব লুটে নিয়ে তাকে নগ্ন করে গাধার পিঠে তুলে দেয়। সম্রাট এই খবরে আমোদ পাবেন, তিনি আমোদ পছন্দ করেন।
মীর হামজাকে সত্যি সত্যি নগ্ন করে গাধার পিঠে চড়িয়ে দেওয়া হলো।
ফজরের নামাজের পরপরই সম্রাট হুমায়ূনের বিশাল বাহিনী বঙ্গদেশের দিকে যাত্রা শুরু করল। তারিখ : ২৭ জুলাই ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দ।
সম্রাট আনন্দিত, কারণ তার দুই ভাই হিন্দাল মীর্জা এবং আসকারি মীর্জা তার সঙ্গে আছেন।
যাত্রার সময় আশ্চর্য এক ঘটনাও ঘটেছে। দু’টি কবুতর সম্রাটের মাথার উপর চক্রাকারে ঘুরেছে। এটি অতি শুভ লক্ষণের একটি।
অগ্রগামী দলে আছে অশ্বারোহী বাহিনী। তার পেছনেই পদাতিক বাহিনী। পদাতিক বাহিনী চলছে হন্তীযুথের সঙ্গে। হাতির সংখ্যা আট শ।
সেনাদল কোথাও না থেমে আসর পর্যন্ত একনাগাড়ে চলবে। আসরের সময় বিশ্রাম এবং আহারের জন্যে থামা হবে। পরদিন আবারও ফজরের নামাজের পর যাত্রা শুরু হবে। যুদ্ধযাত্রার সময় সম্রাট একবেলা আহার করেন।