সভার নিয়ম অনুযায়ী সবাই একসঙ্গে বলল, মারহাবা! মারহাবা!
সম্রাট বললেন, আগ্রার বুলবুল আসহারি, তোমার কি আর কিছু বলার আছে?
আসহারি বলল, আছে। সম্রাটের অভয় পেলেই বলতে পারি।
বলো।
আমি হেরেমবাসী। এতগুলি স্বর্ণমুদ্রা লুকিয়ে রাখা হেরেমে সম্ভব না। আমি আমার এই সম্পদ রাজকোষে জমা দিতে চাই। সম্রাট অনেক জনহিতকর কাজে রাজকোষের সম্পদ ব্যবহার করেন। আমার সামান্য অর্থ সেই কাজে ব্যবহৃত হলেই আমি খুশি হব।
সম্রাট বললেন, তা-ই করা হবে। আমি আগ্রার বুলবুলের কথায় সন্তোষ লাভ করেছি।
দরবারে আম শেষ হওয়ার পর সম্রাট একটা ফরমান জারি করলেন। সেই ফরমানে বলা হলো—এখন থেকে সম্রাট যেখানে যাবেন, প্রমোদভ্রমণ হোক বা যুদ্ধযাত্রা, আগ্রার বুলবুল তাঁর সঙ্গে থাকবে। সে দশজন খোজা প্রহরী থাকবে। মিরনসুর’ পরগনা খেলাত হিসেবে আগ্রার বুলবুলকে দেওয়া হলো। এই পরগনার আয় আগ্রার বুলবুল আসহারি পাবে।
দুই মাসব্যাপী উৎসব শুরু হয়েছে। প্রচণ্ড দাবদাহ। হঠাৎ শীতল হয়ে গেল। আগ্রার উপর ভারী বর্ষণ, এই সঙ্গে শিলাবৃষ্টি। দুই সের ওজনের একটি শিলা এক প্রজা নিয়ে এল বাদশাকে দেখাতে। সম্রাট খুশি হয়ে তাকে একটা আশরাফি দিলেন। এতবড় শিলা তিনি আগে কখনো দেখেন নি। তিনি তাঁর দিনলিপিতে লিখলেন, আল্লাহপাকের রহমত এবং নিদর্শন চারদিকে ছড়ানো। আমরা অন্ধ বলেই তা দেখি না। প্ৰকাণ্ড এক শিলার মাধ্যমে পরম করুণাময় তার নিদর্শন তাঁর দীন সেবককে দেখালেন। সোবাহানাল্লাহ।
শিলাখণ্ড গলিয়ে তার পানি সম্রাট পান করলেন। পানিতে বারুদের গন্ধ তাকে বিস্মিত করল। এটা কি কোনো যুদ্ধের আলামত? তাঁকে কি যুদ্ধযাত্রা করতে বলা হচ্ছে?
শাহি ফরমান জারি হয়েছে
শাহি ফরমান জারি হয়েছে। সম্রাট হুমায়ূন শের খাঁ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবেন। শের খাঁকে বন্দি অবস্থায় দিল্লী আনা হবে। সেই উপলক্ষে মাসব্যাপী উৎসব। উৎসবের নাম ঠিক হয়েছে ‘শের খাতেমুন’, যার অর্থ-শেরের শেষ।
শের খাঁকে বন্দি করতে কতদিন লাগবে এটা বোঝা যাচ্ছে না। সে সরাসরি সম্মুখ সমরে আসে না। চোরাগোপ্তা হামলা করে। তার যুদ্ধ কাপুরুষের যুদ্ধ। মোঘল বাহিনী কাপুরুষ যুদ্ধে অভ্যস্ত না বলেই সমস্যা।
সম্রাট বাংলা মুলুক কখনো দেখেন নি। শের খাঁকে পরাস্ত করে তিনি বাংলা মুলুকে কিছুদিন বাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলা মুলুকের বর্ষার অনেক গল্প শুনেছেন। সেই বর্ষা দেখবেন। বর্ষায় সেখানকার সব নদী নাকি সমুদ্রের মতো হয়ে যায়। এক কুল থেকে আরেক কুল দেখা যায় না। তাঁর নদী দেখার শখ আছে। বাংলা মুলুকের হিজড়ারা নাকি নৃত্যগীতে বিশেষ পারদর্শী। তাদের নৃত্যগীত সাধারণ নৃত্যগীতের চেয়ে আলাদা। কতটা আলাদা সেটাও সম্রাটের দেখার ইচ্ছা। (*সম্রাটের ভাই আসকারি মীর্জা বঙ্গ বিজয়ের পর সম্রাটের কাছে উপহার হিসেবে কয়েকজন হিজড়া চেয়েছিলেন।)
মোঘল সম্রাটদের যুদ্ধযাত্রা বিশাল ব্যাপার। চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। যুদ্ধযাত্রার খরচ হিসেবে আমীররা সঞ্চিত ধনরত্ন জমা দিতে শুরু করলেন। শুধু ধনরত্ন না, তাদেরকে ঘোড়াও দিতে হলো। যে এক হাজারি আমীর সে দেবে এক হাজার ঘোড়া। পাঁচ হাজারি আমীর দেবে পাঁচ হাজার ঘোড়া। করদ রাজ্যের রাজাদের বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্য এবং স্বর্ণমুদ্রা পাঠাতে হলো।
যুদ্ধযাত্রার জন্যে একটা বরগা তাঁবু রওনা হয়ে গেছে। বরগী তাঁবুতে একসঙ্গে দশ হাজার মানুষ দাঁড়াতে পারে। এই তাঁবু খাটাতে এক হাজার তাঁবুর কারিগরকে সাত দিন খাটতে হয়।
সম্রাটের জন্যে যাচ্ছে ডুরসানা-মঞ্জেল তাঁবু। এটি দোতলা। উপরের তলায় সম্রাট নামাজ পড়বেন। নিচতলায় বেগমরা থাকবেন।
সম্রাট রাতে ঘুমাবেন চৌবিলরৌতি তাঁবুতে। এই তাঁবুর চালের নিচে খসখসের সিলিং দেওয়া। নিচেও থাকে খসখস। খসখসের উপর কিংখাব ও মলমল। তাঁবু খাটাবার দড়ি রেশমের।
সম্রাট হুমায়ূন আনন্দের সঙ্গে যুদ্ধপ্ৰস্তৃতি লক্ষ করতে লাগলেন। তাঁর আনন্দ কিছু বাধাগ্রস্ত হলো বৈরাম খাঁ’র কারণে। বৈরাম খাঁ বললেন, দিল্লী ত্যাগ করা মোটেই ঠিক হবে না।
সম্রাট বললেন, সমস্যা কী ?
বৈরাম খাঁ বললেন, সমস্যা আপনার তিন ভাই। আপনার অনুপস্থিতিতে তারা দিল্লীর সিংহাসন দখলের চেষ্টা চালাবে।
হুমায়ূন বললেন, আমি আমার ভাইদের নিজের প্রাণের মতোই ভালোবাসি। তারা তিনজনই আমার সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করবে।
তারা আপনার সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করবে না।
তুমি আমার সঙ্গে বাজি রাখতে চাও ?
সম্রাটের সঙ্গে বাজি রাখার স্পর্ধা এই নফরের নেই। আমার এই তিন ভাইয়ের কারণেই কি তুমি যুদ্ধযাত্রা করতে চাচ্ছ না, নাকি আরও কারণ আছে ?
বাংলা মুলুকে বর্ষা এসে যাবে। মোঘল সেনাবাহিনী বর্ষার সঙ্গে পরিচিত না।
এখন পরিচয় হবে। আমিও পরিচিত হব। কলমচিকে খবর দাও, আমি তিনভাইকে পত্ৰ লিখব। এখনই লিখব।
সম্রাট পত্র লিখলেন। তিনজনকে আলাদা আলাদা চিঠি। মীর্জা কামরানকে লেখা চিঠির নমুনা–
আমার প্রাণপ্রিয় ভ্ৰাতা কামরান মীর্জা।
আমার হৃদয়ের পাখি। বাগিচার সৌরভময় গোলাপ।
প্রিয় ভ্রাতা, বাংলা মুলুকের শের খাঁ নামের দুষ্টকে শায়েস্তা করতে বিশাল মোঘল বাহিনী অতি শীঘ্ৰ যাত্রা শুরু করবে। তুমি তোমার সৈন্যবাহিনী নিয়ে লাহোর থেকে চলে এসো। বড়ভাইয়ের দক্ষিণ বাহু হও। আমার তিন ভাই পাশে থাকলে আমি বিশ্ব জয় করতে পারি। যেমন করেছিলেন জুলকারলাইন। (*আলেকজান্ডার দি গ্রেট)