মাগরেবের নামাজের পর হুমায়ূনকে জানানো হলো, গাধার চামড়া পরিয়ে যে তিন অপরাধীকে সারা দিন ঘুরানো হয়েছে তাদের দু’জন মারা গেছে। একজন এখনো জীবিত। হুমায়ূনের নির্দেশে চামড়া থেকে মুক্ত করে তাকে সম্রাটের সামনে আনা হলো। তার দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। তার সমস্ত শরীর ফুলে গেছে। চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। সম্রাট বললেন, তোমার নাম কী?
সে অতি কষ্টে বলল, সম্রাট, আমি একজন মৃত মানুষ। মৃত মানুষের নাম থাকে না।
তুমি কী অপরাধ করেছিলে?
আপনার এক আমীর আমার অতি আদরের কন্যাকে তার হেরেমে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি সেই নির্দেশ পালন করি নাই। এটাই আমার অপরাধ। আমাকে মিথ্যা হত্যা মামলায় জড়ানো হয়েছিল। মহান কাজি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।
আমার সেই আমীরের নাম কী?
সে নাম বলতে পারল না। ততক্ষণে তার হেঁচকি উঠেছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সে ঠোঁট নাড়ছে কিন্তু মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হলো। (*আমীরের নাম তর্দি বেগ খান। সম্রাট আকবরের সময় বৈরাম খাঁ তাঁকে হত্যা করেন।)
সম্রাট হুমায়ূন এর পরপর একটি রাজকীয় ফরমান জারি করলেন।
যে-কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে সম্রাটের অনুমতি নিতে হবে।
এ ছাড়াও তিনি যুদ্ধে ব্যবহার হয় এমন একটি দামামার ব্যবস্থা করলেন। কোনো প্ৰজা যদি মনে করে তার উপর বিরাট অবিচার করা হচ্ছে, তাহলে সে দামামায় বাড়ি দিয়ে সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে।
এই কাজটা করতে হবে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। এই সময় সম্রাটের শোবার ঘরের জানোলা খুলে যায়। তিনি জানালায় মুখ বের করে প্রজাদের দর্শন দেন। এই দর্শনের নাম ঝড়োয়া কি দর্শন’। প্রজারা সম্রাটকে দেখে আশ্বস্ত হয় যে, সম্রাট বেঁচে আছেন। রাজত্ব ঠিকমতো চলছে।
বাঁশিতে ভৈরবীর সুর বাজছে। সূর্য উঠছে। সম্রাট হুমায়ূন ঝড়োয়া কি দর্শন’ দেবেন। প্রজার দল উপস্থিত।
জানোলা খুলে গেল। সম্রাটের প্রিয় নফর জওহর আবিতাবচি রেশমি পর্দা সরাল। সম্রাটের হাসিহাসি মুখ দেখা গেল। সম্রাটের হাতে একটি ফুটন্ত গোলাপী। তিনি গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে জানালার নিচে সমবেত প্রজাদের দিকে ছুড়ে দিলেন। সম্রাটের ফুল হাতে পাওয়ার জন্য প্রজারা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আর ঠিক তখনই দামামার শব্দ হলো। সম্রাট ভ্রাক্ত কুঞ্চিত করে তাকালেন।
বিচার পেতে ব্যর্থ প্রজারাই শুধু এই দামামায় ঘা দিতে পারে। কে ঘা দিল?
দামামার পাশে সারা শরীর কালো বোরকায় ঢাকা এ জেনানা দেখা যাচ্ছে। সে দামামায় বাড়ি দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
সম্রাট নির্দেশ দিলেন আজ সন্ধ্যায় দরবারে-আম’ বসবে। সেখানে এই জেনানার বক্তব্য প্রথম শোনা হবে। দরবারে আমে প্রবেশের জন্য এই মহিলাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে বলা হলো।
‘ঝড়োয়া কি দর্শন’ শেষ হয়েছে। সম্রাট নিজের ঘরে ফিরে গেছেন। তিনি কিছুক্ষণ কোরান পাঠ করবেন। কোরান পাঠের পর একটি বই পড়বেন। মূল বই হিন্দুস্তানি ভাষায় লেখা (মনে হয় সংস্কৃত কিংবা আদি বাংলা,-লেখক)। সম্রাটের নির্দেশে বইটি ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। বইয়ের শিরোনাম–
অদৃশ্য হইবার মন্ত্র
বইতে হিন্দু যোগীরা কীভাবে অদৃশ্য হন তার বিষদ বর্ণনা এবং মন্ত্র দেওয়া আছে। যেসব উপকরণের উল্লেখ আছে তা হলো, শ্মশানে ভাঙা কলসির মাথা (কালো রঙ), বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তির পাঁজরের হাড়, যে–দড়িতে ফাঁসি হয়েছে সেই দড়ি। প্রথম রজস্বলা কিশোরীর দূষিত রক্ত। ত্ৰিমুখী রুদ্ৰাক্ষ। বেশ্য রমণীর যৌনকেশ… ইত্যাদি।
দরবারে আমে বিচারপ্রার্থী তরুণী উপস্থিত। সম্রাটের নির্দেশে সে মুখের নেকাব খুলেছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির রূপ দেখে সম্রাট হতভম্ব। কী সুন্দর বড় বড় চোখ। চোখের দীর্ঘ পল্লব। সম্রাট বললেন, নাম?
তরুণী আভূমি নত হয়ে বলল, বাঁদির নাম আসহারি।
পরিচয়?
সম্রাটকে দেওয়ার মতো কোনো পরিচয় এই বাঁদির নেই। আমি আপনার হেরেমে বাস করি। আপনার মহান পিতা বাদশাহ বাবরকে একবার গান গেয়ে শোনাবার সৌভাগ্য হয়েছিল।
তোমার অভিযোগ কী?
মহান সম্রাট বাদশাহ বাবর আমার গান শুনে খুশি হয়ে আমায় সমওজনের স্বর্ণমুদ্রা দিতে হুকুম করেছিলেন। আমি তা পাই নাই। অবশ্য খাজাঞ্জিখানা থেকে আমাকে সমওজনের তাম্রমুদ্রা দেওয়া হয়। সেটাও কাগজ-কলমে।
তোমার অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষী আছে?
আমার হৃদয় একমাত্র সাক্ষী। আর কোনো সাক্ষী নাই।
সম্রাট দাওয়াতদারকে (লিখনিসামগ্ৰীর ব্যবস্থাপক। প্রতিদিনের হিসাবরক্ষক।) বললেন, ঐদিনের ঘটনা কী তা যেন রেকর্ড ঘেঁটে জানানো হয়। প্রতিদিনের ঘোষণার কপি কিতাবাদারের (গ্রন্থাগারিক) কাছেও থাকে। তাকেও রেকর্ডপত্র বের করতে বলা হলো।
আসহারি বলল, সম্রাট আমার আর্জি শুনেছেন, এতেই আমার জীবন ধন্য। পুরাতন রেকর্ড খোঁজার প্রয়োজন নেই।
সম্রাট বললেন, কী প্রয়োজন আর কী প্রয়োজন না, তা তোমার কাছ থেকে জানতে আমি আগ্রহী না। আমি আগ্রহী সেই গানটি শুনতে যা আমার মহান পিতা শুনেছিলেন। তুমি কি গান শোনাতে প্রস্তুত হয়ে এসেছ?
জি জাহাঁপনা। সঙ্গীতের আসর বসল। বাদ্যকররা আসহারির সঙ্গে আলোচনা করে তাদের বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে আসহারির গলার সমন্বয় করল।
আসহারি গান করল। গান শেষ হওয়ামাত্র সম্রাট হুমায়ূন ঘোষণা করলেন, পুরাতন নথিপত্র পরে ঘাটা হবে। এই মুহুর্তে গায়িকার ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা তাকে দেওয়া হোক। আমি এই গায়িকাকে আগ্রার বুলবুল সম্মানে সম্মানিত করলাম। আজ থেকে তার নামের আগে আগ্রার বুলবুল ব্যবহৃত হবে।