সম্রাট বললেন, এখন একটি পত্র পাঠ করা হবে। পত্রপাঠের পর পত্রের উপর আলোচনা। পত্ৰ পাঠিয়েছেন। আফগান পাঠান—শের খাঁ।
সম্রাটের নির্দেশে প্রধান উজির পত্ৰ পাঠ করলেন।
পত্র
প্রেরক : দাসানুদাস সেবক শের শাহ।
প্রাপক : আল সুলতান আল আজম ওয়াল খাকাল আল মুকাররাম, জামিই সুলতানাত-ই-হাকিকি ওয়া মাজাজি, সৈয়দ সালাতিন, আবুল মোজাফফর নাসির উদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ূন পাদশাহ, গাজি জিলুল্লাহ।
হে মহান সম্রাট, হিন্দুস্থানের রক্ষাকর্তা ও মালিক। আল্লাহপাকের অনুগ্রহের ফুটন্ত গোলাপী। মহান কবি ও চিত্রকর হুমায়ূন।
হে বাদশাহ, আপনি কি অধম শের খাঁ’র উপর নারাজ হয়েছেন? হিন্দুস্থান হলো গুজবের বাজার। সেই বাজারের বর্তমান দুৰ্গন্ধময় গুজব হলো— আপনি অধম শের খাঁ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
হে সম্রাট! আমি কি এমন কিছু করেছি। যার জন্যে আপনার বিরাগভাজন হয়েছি? চুনারের দুর্গ আমার পুত্র কুতুব খাঁর দখলে, এটা সত্য। সম্রাটের আদেশ পাওয়ামাত্র কুতুব খাঁ দুর্গের চাবি আপনার পবিত্র হাতে তুলে দিয়ে আপনার পদচুম্বন করবে। তবে আপনার কোনো প্রতিনিধির হাতে না। আপনি স্বয়ং উপস্থিত হলে তবেই দুর্গের চাবি আপনার হস্ত মোবারকে দেওয়া হবে। আমি পুত্রকে নিয়ে বঙ্গদেশের ভেতরে চলে যাব। এর অন্যথা কখনো হবে না।
হে পবিত্র সম্রাট, আপনি গুপ্তচর মারফত খবর নিয়ে নিশ্চয়ই জেনেছেন আমি আমার নিজের নামে খুৎবা পাঠ করাই না। মহান মোঘল সম্রাট হুমায়ূনের নামেই জুমার নামাজে খুৎবা পাঠ করা হয়। টাকশাল থেকে আমার নামে কোনো মুদ্রা তৈরি হচ্ছে না।
এই অধম যেখানে সম্রাটের সেবায় নিযুক্ত তখন আপনি তার উপর বিরাগ হচ্ছেন, অথচ আমি যতদূর জানি আপনার ভাই আসকারি মীর্জা এবং কামরান মীর্জা তাদের নামে খুৎবা পাঠ করছেন। টাকশালে তাদের নামে স্বর্ণমুদ্রা তৈরি হচ্ছে। এরকম কিছু মুদ্রা আপনার কাছে পাঠালাম।
মহান সম্রাট, আপনার দুই ভাইয়ের নাম এখানে এনে যদি অপরাধ করে থাকি তাহলে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আপনার মহান পিতা বঙ্গদেশের ফল আমি অত্যন্ত পছন্দ করতেন। আমি আম এবং আরও কিছু বঙ্গদেশীয় ফল আপনার সেবার জন্যে পাঠালাম। এই সঙ্গে একটি বিষ্ণুমূর্তি। বিষ্ণুমূর্তিটির ওজন এগারো সের। সম্পূর্ণ স্বর্ণনির্মিত, এর চোখ নীলকান্তমণির। এই বিষ্ণুমূর্তি বিষয়ে প্রচলিত গল্প হলো, ভয়াবহ বিপদের আগে আগে সে অশ্রু বর্ষণ করে। রহস্যময় বিষয়ে আপনার আগ্রহের কথা জানি বলেই বিষ্ণুমূর্তি বিষয়ে প্রচলিত গল্পটি জানালাম।
ইতি
শের খাঁ
আপনার দাসানুদাস সেবক।
রোশন কাকু (আমীর) বললেন, আমি শের খাঁ’র পত্রে সন্তোষ বোধ করছি।
বৈরাম খাঁ বললেন, দুষ্টলোকের ছলনায় ভোলার কোনো কারণ দেখি না।
কাকু বললেন, শের খাঁ তার নামে খুৎবা পাঠ করে না, এটা তো সত্য। তার নামে মুদ্রা বের হয় নি, এটাও সত্য।
বৈরাম খাঁ বললেন, খুৎবা পাঠ করলেই সম্রাটের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে। শের খাঁ বুদ্ধিমান বলেই খুৎবা পাঠ করছে না। শক্তি সঞ্চয় করছে। চুনার দুর্গ যদি শের খাঁ’র দিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে সম্রাটের যে-কোনো প্রতিনিধির কাছে দুর্গ দেবে। স্বয়ং সম্রাটকে কেন উপস্থিত হতে হবে?
উজির তর্দি বেগ খান বললেন, আপনি কি মনে করেন সম্রাটের যুদ্ধযাত্রা করা উচিত?
বৈরাম খাঁ বললেন, অবশ্যই উচিত। এবং এখনই যুদ্ধযাত্রা করা প্রয়োজন।
তৰ্দি বেগ বললেন, এখনই কেন?
বৈরাম খাঁ বললেন, সম্রাটের অনুমতি পেলে আমি ব্যাখ্যা করব কেন কালবিলম্ব না করে যুদ্ধযাত্রা করা উচিত।
সম্রাট বললেন, অনুমতি দেওয়া হলো।
বৈরাম খাঁ বললেন, শের খাঁ হলো ধূর্ত শেয়াল। সুন্দর একটি চিঠি পাঠিয়ে সে সম্রাটকে শান্ত করেছে। সে কল্পনাও করছে না সম্রাট এরকম একটি চিঠি পাওয়ার পরও যুদ্ধযাত্রা করবেন। কাজেই সে নিশ্চিন্ত আছে। রাজকীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো প্ৰস্তুতি তার নেই। এই সুযোগে মোঘল সৈন্য অতর্কিতে শের খাঁ’র ঘাড়ের উপর পড়লে চিরদিনের মতো আফগান শক্তির পতন হবে।
সম্রাট বললেন, আলোচনা বন্ধ। সবাইকে আমি হামামখানায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
উপস্থিত অমাত্যদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। সবাই পানিতে নামল।
সম্রাট শের খাঁ’র পাঠানো ফল এবং বিষ্ণুমূর্তি গোসলখানায় আনার নির্দেশ দিলেন। বিষ্ণুমূর্তি দেখে সম্রাট বিস্মিত হলেন। এত সুন্দর কাজ! সম্রাট বললেন, যে কারিগর এই মূর্তি তৈরি করেছে তার উদ্দেশে মারহাবা।
সবাই বললেন, মারহাবা!
প্রধান উজির বললেন, রাজকোষে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি থাকা বাঞ্ছনীয় না। মূর্তি গলিয়ে সোনা করে রাজকোষে জমা হোক।
হুমায়ূন বললেন, না। এই মূর্তি যেমন আছে তেমন থাকবে। আমি আজ তার সঙ্গে স্নান করব।
বিষ্ণুমূর্তি হাম্মামে নামিয়ে দেওয়া হলো। বঙ্গদেশের ফলগুলির মধ্যে একটি সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। অত্যন্ত রসালো ফল। মুখে দিলেই জিভের রঙ বদলে কালো হয়ে যাচ্ছে। এই ফলের কী নাম কেউ বলতে পারল না। ফলটি কালো জাম, কিংবা তুঁত।]
হুমায়ূন গোসলখানায় ঘোষণা দিলেন শের খাঁ’র বিষয়ে তাঁর কোনো উদ্বেগ নেই। তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করার কিছু নেই। বাহাদুর শাহ পরাজিত হয়েছে। পর্তুগীজদের হাতে সে নিহত। সে অপুত্ৰক বিধায় তাকে এবং তার বংশধর নিয়ে আর চিন্তার কিছু নেই। সেই উপলক্ষে তেমন কোনো আনন্দ-অনুষ্ঠান হয় নি। দুই মাসব্যাপী আনন্দ উৎসব হবে। এই দুই মাসে প্রতিদিন দশজন করে সাধারণ প্ৰজা আমার সঙ্গে রাজকীয় খানায় অংশগ্রহণ করবে।