বেলায়েত সব সময় ব্যস্ত। এই ব্যবসা সেই ব্যবসা। ঢাকা শহরে তার একটা রেস্টুরেন্ট আছে। নাম দি নিউ বিরানী হাউস এন্ড রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্টের সমস্ত বাজার বেলায়েত নিজে করে। সকাল আটটা বাজার আগেই বাজারে যেতে হয়। রেস্টুরেন্টের বাবুর্চির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর সে যায় কাওরান বাজার। এখানে তার একটা কাঠ চেরাইয়ের কল এবং কাঠের দোকান আছে। দোকানের নাম বেলায়েত টিম্বার। দুপুর একটা পর্যন্ত সে বেলায়েত টিম্বারে থাকে। এখান থেকে সে যায় কলাবাগানে। এখানে সে এক কামরার একটা ঘর ভাড়া করেছে। নিউজ স্ট্যান্ড দেয়া হয়েছে। নানান ধরনের পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন বিক্রীর ব্যবস্থা। দোকানে এখনো কাজ চলছে। র্যাক বনানো হচ্ছে। পত্রিকার সঙ্গে ডিভিডি এবং গানের সিডিও বিক্রী হবে। ডিভিডির ব্যবসা এখন ভালো চলছে।
সন্ধার পর সে কলাবাগানে বাড়ির কাজ দেখে। মিস্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ, টাকা-পয়সার হিসাব— এইসব। কলাবাগানের দোতলা বাড়ির ডিজাইন সে নিজেই করেছে। ডিজাইন মতো বাড়ি তৈরির কাজ দেখছে একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার–পরিমল বাবু। বয়স ষাট। পরিমল বাবুর সবচেয়ে বড় গুণ বেলায়েত যে ডিজাইন করে পরিমল বাবু বলেন, অসাধারণ! পশ্চিমের জানালা অফ করে দিয়ে আপনি ভালো করেছেন। বিকেলে সূর্যের চিড়বিড়া আলোর কোনো দরকার নেই। ফালতু খরচ। আবার পশ্চিমের জানালা রেখে দিলে তিনি বলেন, স্যার আপনি যা করেছেন বাংলাদেশে কোনো আর্কিটেক্টের মাথায় এই জিনিস ঢুকবে না। সূর্য ডোবার আগে আগে কন্যা-সুন্দর আলোর পবিত্রতা বুঝার বুদ্ধি এদের নেই। আপনি বয়সে ছোট। বয়সে ছোট না হলে আপনার পায়ের ধুলা নিতাম।
হেদায়েত তার বড় ভাইয়ের খোঁজে কলাবাগানে এসেছে। এই সময় বেলায়েতকে পাওয়া যায় বাড়ির ছাদে। কয়েক দিনের মধ্যে ছাদ ঢালাই হবে। তার প্রস্তুতি চলছে। রড বাঁধাইয়ের কাজ হচ্ছে। ব্লড মিস্ত্রী আবদুর রহমান গুনাসুতা দিয়ে রড বাঁধছে। তার কাজের সুবিধার জন্য দু’শ পাওয়ারের একটা ভান্তু তার চোখের সামনে জ্বলছে। কাজ তদারক করছেন পরিমল বাবু। তার তদারকির অর্থ সারাক্ষণ কথা বলে যাওয়া।
সব কিছুর মা আছে বুঝলে আব্দুর রহমান। বাড়ির মা হলো তার ছাদ।
কিসের মাসি কিসের পিসি কিসের বৃন্দাবন
মরা গাছে ফুল ফুটেছে মা বড় ধন।
এখন বল দেখি বাড়ির বাবা কে? মা’কে তা তো জেনে গেছ, এখন বল বাবা কে?
আব্দুর রহমান বিরক্ত মুখে বলল, জানি না স্যার।
পরিমল বাবু বললেন, একটু বুদ্ধি খেলাও। বুদ্ধি খেলালেই বলতে পারবে।
আব্দুর রহমান বিড়বিড় করে বলল, আপনে বুদ্ধি খেলায়া বলেন। আমি পারব না।
বাড়ির বাবা হলো পিলারগুলি। বাড়ি দাড়িয়ে থাকে এর উপর। বুঝেছ?
জ্বি স্যার বুঝেছি।
এখন বল দেখি বাড়ির মামা খালা—এরা কে?
কথাবার্তার এই পর্যায়ে হেদায়েত সিঁড়িঘর থেকে ছাদে এসে দাঁড়াল। তাকে অপ্রস্তুত মনে হলো। তার হাতে লাল রঙের দু’টা হাওয়াই মেঠাই। পলিথিনের প্যাকেটে ভরা। হেদায়েত তার ভাইয়ের জন্য এই হাওয়াই মেঠাই কিনেছে। এখন তার সামান্য লজ্জা লাগছে। হাওয়াই মেঠাই শিশুদের প্রিয় জিনিস। বেলায়েতের ছেলে-মেয়ে নেই যে তাদেরকে দিয়ে দেয়া যাবে। হেদায়েত হাওয়াই মিঠাইর ঠোঙ্গা দুটা লুকাতে চেষ্টা করল।
বেলায়েত বলল, আছিস কেমন?
হেদায়েত অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, ভালো।
তোর বৌ আছে কেমন?
ভালো।
ঝগড়া-টগড়া হয়েছে না-কি?
হাওয়াই মেঠাই কার জন্য এনেছিস?
তোমার জন্য।
এনেছিস যখন দে। লুকানোর কী আছে?
হেদায়েত ভাইয়ের হাতে ঠোঙ্গা দু’টা দিল। আনন্দে বেলায়েতের চোখে প্রায় পানি এসে গেল। তার ছোট ভাইটাকে সে নিজেই কোলে-পিঠে করে বড় করেছে। হেদায়েতের জন্মের পর তার মা মারা গেলেন। একলেমশিয়া রোগে। এই মা বেলায়েতের মা না, সত্যা। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর বেলায়েতের বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। হেদায়েতের যখন তিন বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গেছেন দাঁত মাজতে। সেখানে ধুম করে মেঝেতে পরে যান। তাকে নিয়ে ছোটাছুটি শুরু হলো। হেদায়েত ভয় পেয়ে তার ভাইয়ের গলায় ঝুলে পড়ল। সে কিছুতেই নামবে না। ভাইকে গলায় ঝুলন্ত অবস্থায় নিয়েই বেলায়েত স্ট্যাক্সি ডেকে আনল। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ট্যাক্সিতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। বেলায়েত বুঝতে পারে নি, সে তখন ব্যস্ত ছোট ভাইয়ের ভয় কাটাতে।
বেলায়েত হাওয়াই মিঠাই ছিড়ে ছিড়ে মুখে দিচ্ছে। ভাব করছে যেন খুবই আনন্দ পাচ্ছে। বেচারা একটা জিনিস শখ করে এনেছে। আগ্রহ করে না খেলে মনে কষ্ট পাবে।
দাম কত নিয়েছে রে?
দশ টাকা পিস।
বেলায়েত বলল, প্রডাকশন কষ্ট কত কে জানে? অল্প হওয়ার কথা। মুখে দিলেই মিলিয়ে যাচ্ছে, আসল জিনিস নাই বললেই হয়। প্রডাকশন কস্ট যদি এক টাকাও ধরি তা হলেও পার পিসে নয় টাকা লাভ। পরিমল বাবু!
জ্বি সার।
একটু খোঁজ নিবেন তো হাওয়াই মেঠাইয়ের পার পিসে প্রডাকশন কস্ট কত হয়?
কালই খোঁজ নিব।
হাওয়াই মেঠাই এর ইংরেজি নাম কী জানেন না-কি?
জ্বি না স্যার।
হেদায়েত তুই জানিস?
হেদায়েত বলল, ইংরেজি নাম Candy Floss।
বেলায়েতের মুখে তৃপ্তির হাসি দেখা দিল। তার ভাই জানে না এমন কোনো জ্ঞান পৃথিবীতে নেই। অসাধারণ একটা ছেলে। মাশাআল্লাহ।
হেদায়েত।
জ্বি ভাইজান।
পরিমল বাবুকে পৃথিবীর ব্যাপারটা বল তো।