জ্বি।
অংকের ক্লাসে দাড়িপাল্লাটা কি জনে বুঝলাম না।
হেদায়েত বলল, হেনরি ক্যাভেনডিস কীভাবে পৃথিবীর ওজন বের করেছিলেন এটা বুঝাবার জন্যে একটা দাড়িপাল্লা নিয়ে গিয়েছিলাম। স্যার আপনি কি পৃথিবীর ওজন জানেন?
না।
পৃথিবীর ওজন হলো (৫৯৭৬x১০)^২১ কিলোগ্রাম। ক্যাভেনডিস সাহেব ওজনটা কীভাবে বের করেছিলেন বুঝিয়ে বলব? শুনলে আনন্দ পাবেন।
এনায়েত করিম সাহেব বললেন, না। আমাকে বুঝিয়ে বলার দরকার নাই। আপনি অংকের শিক্ষক, অংক শেখাবেন। দাড়িপাল্লা দিয়ে পৃথিবীর ওজন মাপা আপনার কাজ না।
জ্বি আচ্ছা।
আপনার সঙ্গে আমার কথাবার্তা ফার্স্ট ওয়ার্নিং হিসাবে ধরবেন। আপনি ভালো শিক্ষক, এতে সন্দেহ নাই। কিন্তু নানান কমপ্লেইন আপনার সম্পর্কে আসছে। এটা ঠিক না।
কী কমপ্লেইন আসছে?
পড়া বাদ দিয়ে পৃথিবীর ওজন মাপা, ব্যক্তিগত গল্পগুজব করা। সবই তো কমপ্লেন। ক্লাস রুম ব্যক্তিগত বৈঠকখানা তো না।
স্যার উঠি?
এনায়েত করিম মাথা নাড়লেন এবং মনে মনে বললেন, গাধার বাচ্চা গাধা।
সামান্য মন খারাপ করে হেদায়েত টিচার্স কমনরুমে বসে আছে। আজ তার একটাই ক্লাস ছিল। ইচ্ছা করলে বাসায় চলে যাওয়া যায়, তবে প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলেছেন ক্লাস শেষ করেই কেউ বাড়ির দিকে কেউ রওনা হবেন না। ক্লাসের পরেও অনেক দায়িত্ব থাকে। অফিস যেমন দশটা-পাঁচটা, কলেজও দশটা-পাঁচটা।
কালিপদ আরেক কাপ চা নিয়ে এসেছে। হেদায়েত চায়ে চুমুক দিল। কালিপদ গলা নামিয়ে বলল, আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলতাছে। অংকের নতুন শিক্ষক খুঁজা হইতাছে। শুনছি একজন পাইছে। মহিলা।
হেদায়েত বলল, ও আচ্ছা!
সবকিছুর মূলে আছে আজিজ স্যার।
হেদায়েত আবারও বলল, ও আচ্ছা।
কালিপদ গলা নামিয়ে বলল, তবে আপনেরে কিছু করতে পারবে না। আপনার মতো শিক্ষক কই পাইব? মহিলা শিক্ষক দিয়া অংক আর বাছুর দিয়া হাইল জমি চাষ এক জিনিস।
হেদায়েত বলল, হুঁ হুঁ!
আজকার মতো আপনার ক্লাস শেষ?
হুঁ।
বাড়িতে চলে যান। ঝিম ধরে বইসা থাইকা ফয়দা কী?
তাও ঠিক।
আপনেরে দেইখা মনে হয় চিন্তার মধ্যে আছেন? ঠিক ধরছি কি-না বলেন।
ঠিক ধরেছ।
কী নিয়া চিন্তা করেন?
প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে একটা ভুল তথ্য দিয়েছি, এটা নিয়ে চিন্তার মধ্যে পড়েছি।
উনারে কী বলেছেন?
পৃথিবীর ওজন কত সেটা বলেছি। মূল সত্যটা বলা হয় নাই। মূল সত্য হচ্ছে পৃথিবীর কোনো ওজন নাই। পৃথিবীর ওজন শূন্য।
শূন্য?
হুঁ। পৃথিবীর ওজন যেমন শূন্য, তোমার আমার সবার ওজনও শূন্য। বুঝিয়ে বলব- ফাল্ডামেন্টাল পার্টিকেলস হলো ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন। এদেরও ভাঙ্গা যায়। সবশেষে আমরা পাই লেপটনস। এদের কোনো ভর নাই। কাজেই পৃথিবীর কোনো ভর নাই। আমাদের কারোরও নাই। বুঝেছ?
জ্বি।
তাজ্জব হয়েছ না?
হয়েছি।
হেদায়েত বলল, স্ট্রিং থিওরি কথা শুনলে আরো তাজ্জব হবে। অদ্ভুত ব্যাপার! রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখবে ছোট বড় স্ট্রিং।
কালীপদ বলল, স্যার আরেক দিন শুনব। এখন ঘণ্টা দিব। ঘণ্টার সময় হয়ে গেছে।
ঘণ্টা দিয়ে চলে আস।
স্যার আইজ না। কিছু কাজও আছে।
আচ্ছা— আরেক দিন।
হেদায়েত কাঠের চেয়ারে হেলে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে থাকতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। বিকাল চারটার দিকে প্রিন্সিপ্যাল স্যার হেদায়েতের ঘুম ভাঙ্গালেন বিরক্ত গলায় বললেন— যান বাড়িতে যান। বাড়িতে গিয়ে ঘুমান। কোনো শিক্ষক চেয়ারে বসে নাক ডেকে ঘুমাচেই দেখতেও খারাপ লাগে। রাতে জেগে থাকেন না-কি?
হেদায়েত বলল, জ্বি আচ্ছা স্যার।
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, জ্বি আচ্ছা স্যার মানে? কী প্রশ্ন করছি— আর কী জবাব দিচ্ছেন! আজ কী বার বলুন তো?
বুধবার।
যান বাড়িতে যান। আর যেন আপনাকে কলেজে এসে ঘুমোতে না দেখি।
হেদায়েত রিকশা করে বাড়ি ফিরছেন। মাথায় ঘুরছে বুধবার। বুধগ্রহ থেকে বারের নাম হয়েছে বুধ। বুধ সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ! মাত্র ৮৮ দিনে সূর্যের চারদিকে একবার চক্কর দেয়। মেরিনার দল এই গ্রহটার খুব কাছাকাছি গিয়েছিল ১৯৭৪ সনের মার্চ মাসে। মাত্র ৪৩৫ মাইল দূর থেকে মেরিনার ছবি তুলেছে।
আচ্ছা সন্ধ্যা তারা কি মারকারি না ভেনাস? হেদায়েত মনে করতে পারছে না। নিজের উপর অত্যন্ত বিরক্ত লাগছে। মনে থাকবে না কেন?
রিকসাওয়ালা বলল, কই যাবেন বললেন না?
হেদায়েত বলল, একটু পর বলি, একটা বিষয় মনে করার চেষ্টা করছি।
কোন দিকে যাব, সেটা বলেন।
হেদায়েত হতাশ গলায় বলল, কেন বিরক্ত করছ?
রিকশা উল্টা দিকে যাচ্ছে। হেদায়েত তাতে তেমন কোনো সমস্যা দেখল। কলাবাগানের কাছাকাছি গেলে রিকশা থেকে নেমে পড়লেই হবে। কলাবাগানে হেদায়েতের বড় ভাইয়ের বাড়ি। বড় ভাইয়ের নাম বেলায়েত। সপ্তাহে তিন দিন বড় ভাইকে না দেখলে হেদায়েতের খুব খারাপ লাগে। এই সপ্তাই শেষ হতে চলল, এখনও তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। পর পর তিন দিন দেখা করতে হবে—বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্র।
বাংলাদেশের অতি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ
বাংলাদেশের অতি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষদের একজন হলো বেলায়েত। সরল রেখার মতো রোগা। ছোট মুখ। নাকের নিচে বেমানান গোঁফ। গোঁফ সবই পাকা। প্রতি পনেরো দিনে সে গোঁফে কলপ দেয়। কলপ দেয়ার পর পর তার এলার্জিক রিএকশন হয়। ঠোঁট-মুখ ফুলে উঠে। দুই দিন ফোলা এবং জ্বলুনি থাকে। বেলায়েত নানান ধরনের কলপ ব্যবহার করে দেখেছে। কোনো লাভ হয়নি।