হেদায়েত সাবধানে খাট থেকে নামল। পানি খাবার জন্য প্রথমে রান্না ঘরে যাবে না-কি প্রথম যাবে বাথরুমে এই নিয়ে সামান্য সমস্যা হলো। ছোটখাট বিষয় নিয়ে তার মাঝে মাঝে বেশ সমস্যা হয়। সে ঠিক করল প্রথমে বাথরুমে যাবে। তৃষ্ণায় পানি খাওয়া আরামের ব্যাপার। বাথরুমের অস্বস্থি মাথায় থাকলে পানি খাবার আনন্দটা থাকবে না।
বড় এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে হেদায়েত ঘুমুতে গেল। ঘড়িতে বাজছে দু’টা পাঁচ। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। ঘরে বাতি জ্বললে সে ঘুমুতে পারে না। বাতি নেভাতে ভয় ভয় লাগছে। হেদায়েত বাতি নেভাল। সেতু যে দিকে শোয় সেদিকে সরে গেল। সেতুর বালিশে মাথা রাখল। এখান থেকে সুইচে সহজেই হাত যাবে। তা ছাড়া আগের মতো হাত টেবিলে যাবে না। অন্ধকারে সুইচ খুঁজে না পাওয়া গেলেও সমস্যা নেই। পাশের বালিশে টিভির রিমোট কন্ট্রোলটা রাখা আছে। পাওয়ার বাটনে চাপ দিলেই টিভি চালু হবে। সুইচ না টিপেও ঘর আলো করার মতো ব্যবস্থা করা যাবে। হেদায়েত চোখ বন্ধ করল। চোখ খোলা থাকলে ঘর যতটা অন্ধকার থাকে চোখ বন্ধ করলে ততটা থাকে না। এটা একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। মানব মস্তিষ্ক হয়তো অন্ধকার পছন্দ করে না। নিজেই নিজের জন্য কিছু আলোর ব্যবস্থা করে। হেদায়েত টিভির রিমোট কন্ট্রোলটার জন্যে হাত বাড়াল। রিমোট হাতেই ধরা থাকুক। তেমন সমস্যা দেখা দিলে যেন রিমোটের জন্য হাতড়াতে না হয়।
রিমোটটা পাওয়া যাচ্ছে না। বালিশ থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেছে। হেদায়েত বালিশ থেকে হাত বিছানায় নামিয়ে আনতেই অন্য একটা হাতের উপর হাত পড়ল। সেই হাতের আঙ্গুল আলতো করে আঙ্গুল চেপে ধরেছে। আঙ্গুল বরফের মতো শীতল।
হেদায়েত বিকট চিৎকার করতে শুরু করল। নাদুর মা জেগে উঠেছে। দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে আতঙ্কিত গলায় বলছে— ভাইজান কী হয়েছে? দরজা খুলেন ভাইজান। হেদায়েত গোংগানীর মতো করে চিৎকার করছে–সুইচটা কোন দিকে? নাদুর মা সুইচ কোন দিকে?
এ সময় সে সুইচ খুঁজে পেল। বাতি জ্বালালেী। কোথাও কিছু নেই। বালিশের উপর টিভির রিমোট কন্ট্রোল।
সেতু বাসায় ফিরল সকাল দশটার কিছু পর। হেদায়েত তখনও ঘুমুচ্ছে। নাদুর মা বলল, ভাইজানের কি জানি হইছে। রাইতে এমন চিৎকার!
বল কি!
এমন অবস্থা হইছিল একবার ভাবলাম দরজা ভাইঙ্গা ভিতরে ঢুকি।
পেটে ব্যাথা বা এরকম কিছু?
জ্বে না— স্বপ্ন দেইখ্যা এই অবস্থা।
কী স্বপ্ন?
জিজ্ঞাস করি নাই। রাইতে স্বপ্নের বিষয়ে কোনো কথা বলা ঠিক না। এখন আপনে গিয়া জিগান। দরজা খোলা আছে। ভাইজানকে বলছি দরজা খোলা রাইখা ঘুমান। আবার কী স্বপ্ন দেখেন তার নাই ঠিক।
সেতু শোবার ঘরে ঢুকে দেখে সব কটা বাতি জ্বলছে। হেদায়েত টিভির রিমোট কন্ট্রোল হাতে ধরে ঘুমাচ্ছে। গায়ে হাত দিয়ে ঘুম ভাঙ্গাতেই হেদায়েত চেঁচিয়ে বলল, না না না!
সেতু বলল, উঠে বস তো। কী স্বপ্ন দেখেছ বল? তুমি তো সাত-আট বছরের বাচ্চা না। এমন কী দুঃস্বপ্ন দেখলে যে চিৎকার চেঁচামেচি করে অস্থির? হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা খেতে আস। তোমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব বলে আমি শুধু এক কাপ চা খেয়েছি।
হেদায়েত দেখল সেতু তিন নম্বর ড্রয়ার খুলছে। হীরার আঙটির এখনই খোঁজ পড়বে। হেদায়েত প্রায় দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। সে অপেক্ষা করছে কখন সেতু বলবে আঙটি কোথায়? সেতু কিছু বলছে না। মনে হয় ঝড়টা উঠবে নাশতার টেবিলে। সবকিছু গুছিয়ে রাখা দরকার। সমস্যা একটাই টেনশনের সময় হেদায়েত গুছিয়ে কথা বলতে পারে না।
নাশতার টেবিলে সেতু আঙটির প্রসঙ্গ তুলল না। পরোটা মুখে দিতে দিতে বলল, স্বপ্নটা কী দেখেছ বল?
হেদায়েত বলল, একটা হাত দেখেছি।
হাতটা কী করল, তোমার গলা চেপে ধরল?
উঁহু।
তাহলে কী? একটা হাত দেখে শুধু শুধু তো কেউ ভয় পাবে না। ছেলের হাত না মেয়ের হাত, না-কি ভূত-পেত্নীর হাত?
মেয়ের হাত।
মেয়ের হাত কী করে বুঝলে— আঙটি পরা ছিল?
হেদায়েত জবাব না দিয়ে অবাক হয়ে সেতুর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সেতুর হাতে হীরার আঙটি ঝলমল করছে। হেদায়েত জানে এই আঙটি সে বাথরুমে খুঁজে পেয়ে তিন নম্বর ড্রয়ারে রাখে নি।
সেতু বলল, কথা বলছ না কেন? আঙটি পরা হাত দেখেছ?
হাতের আঙ্গুলগুলি কেমন ছিল? আমার আঙ্গুলের মতো সুন্দর? প্রশ্ন করে করে জানতে হচ্ছে কেন? তুমি নাশতা শেষ করে হড়হড় করে সব বলবে।
আজ তোমার কলেজ নেই? আছে তো! সর্বনাশ!
হেদায়েত নাশতার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। বারোটায় কোঅর্ডিনেট জেওমেট্রির একটা ক্লাস তার আছে। আজকের বিষয় Circle.
বেগম রোকেয়া মেমোরিয়েল কলেজ
বেগম রোকেয়া মেমোরিয়েল কলেজ হেদায়েতের বাসা থেকে বেশি দূরে না। হেঁটে যেতে লাগে উনিশ মিনিট। রিকশায় লাগে পঁচিশ মিনিট। তবে ছুটির দিনে সময় বেশি লাগে। হেঁটে যেতে লাগে তেইশ মিনিট। রিকশায় লাগে সাতাশ মিনিট। ছুটির দিনে রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকলেই সবার মধ্যে আলস্য চলে আসে। সবই হেদায়েতের হিসাব করা। হাঁটা পথে তিন মিনিটের আলস্য।
হেদায়েত রিকশা নিয়ে নিল। রিকশায় চিন্তা করার সুযোগ বেশি। কোনো দিকে তাকাতে হয় না। রিকশাওয়ালা যুবক, চেহারা সুন্দর। হাতে ঘড়ি আছে। ঘড়ি পরা রিকশাওয়ালা খুব কম দেখা যায়। হেদায়েত বলল, তোমার নাম কি নাদু?
রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে বলল, আমার নাম কালাম। নাদু হবে কী জন্য?