খাটের পাশে রাখা টেলিফোন বাজছে। নিশ্চয়ই সেতুকে কেউ টেলিফোন করেছে। এ বাড়িতে হেদায়েতকে টেলিফোনে কেউ চায় না। তা ছাড়া রাত অনেক হয়েছে। সবাই জানে এত রাত পর্যন্ত হেদায়েত জেগে থাকে না।
ধরবে না ধরবে না করেও হেদায়েত টেলিফোন ধরে অনভ্যস্ত গলায় বলল, কে? কে?
ওপাশ থেকে সেতু বলল, টেলিফোন ধরেই কেউ কে কে বলে? সাধারণ ভদ্রতাও শিখবে না? প্রথমে বলবে হ্যালো, তারপর অন্য কিছু।
সরি!
খেয়েছ?
হুঁ।
কী-জন্যে টেলিফোন করেছি মন দিয়ে শোনো। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম আমার হতে হীরার আঙটিটা নাই। খুলে পড়ে গেছে কি-না বুঝতে পারছি না। এদিকে এত আনন্দ হচ্ছে আমি কিছুতেই মন দিতে পারছি না। তুমি কি বাথরুমে একটু দেখবে আঙটিটা আছে কি-না। মাঝে মাঝে হাত-মুখ ধোয়ার সময় আমি আঙটি খুলে বেসিনে রাখি।
দেখে আসছি। আমি টেলিফোন ধরে আছি। তুমি দেখে এসে আমাকে বল।
বাথরুমের বেসিনে বা অন্য কোথাও আঙটি নেই। হেদায়েত ফিরে এসে টেলিফোন ধরল। সেতু বলল, পেয়েছ?
হেদায়েত অস্পষ্ট স্বরে বলল, হুঁ।
সেতু বলল, স্পষ্ট করে বল পেয়েছ, না-কি পাও নি?
পেয়েছি।
থ্যাংক গড। আঙুটিটা কি এখন তোমার হাতে?
না।
তা হলে কোথায়?
যেখানে ছিল সেখানেই রেখে এসেছি।
তোমার কি মাথাটা খারাপ? আঙটিটা এনে তিন নম্বার ড্রয়ারে রাখ।
আচ্ছা রাখছি।
এখানে খুবই মজা হচ্ছে। রবিন ভাই ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। দড়ি কাটা একটা ম্যাজিকের কৌশল আমি ধরে ফেলেছি।
কী কৌশল?
কী কৌশল আমি কি টেলিফোনে বুলব না-কি? আচ্ছা আমি রাখছি। তুমি আঙটিটা এনে টেবিলের তিন নম্বর ড্রয়ারে রাখ।
আচ্ছা।
সেতু টেলিফোন রেখে দিয়েছে। হেদায়েত সামান্য অস্বস্থি বোধ করছে। কাল সেতু যখন দেখবে ড্রয়ারে আঙটি নেই তখন কী হবে? হেদায়েত ভুড় কুঁচকে আগামীকালের কথাবার্তা কী হবে চিন্তা করার চেষ্টা করছে–
কেন বললে আঙুটি পেয়েছ? কেন মিথ্যা কথা বললে?
তুমি আনন্দ করতে পারছিলে না। মনটা খারাপ করে ছিলে।
আজ যখন দেখলাম আঙটি নাই— মনটা কি ভালো হয়েছে? চুপ হয়ে। থাকবে না, জবাব দাও।
হেদায়েত বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। আগামীকাল কী হবে সেটা আগামীকাল দেখা যাবে। মানুষ ভবিষ্যতে বাস করে না। বর্তমানে বাস করে। ঘুমানোর আগে জটিল কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হেদায়েতের ভালো লাগে। এই মুহূর্তে সে চিন্তা করছে— আলোর গতি নিয়ে। আইনস্টাইন প্রমাণ করেছেন আলোর গতি ধ্রুবক। কেউ আলোর দিকে এগিয়ে গেলেও সে যে গতি পাবে আলো থেকে উল্টো দিকে দৌড়ালেও একই গতি। সব সময় সব অবস্থায় আলোর গতি এক— এটা কি ঠিক। বিগ ব্যাং এর সময়েও কি তাই ছিল? কোনো কোনো অবস্থায় আলোর গতির হেরফের হতে পারে- এটা ভাবলে কেমন হয়? অতি ক্ষুদ্র জগৎ অর্থাৎ প্লংকের জগতেও কি আলোর একই।
বড় বড় বিজ্ঞানীরা মাঝে মাঝে বিজ্ঞানের ক্ষতিও করেন। তাদের থিওরির বাইরে অন্যরা চিন্তা বন্ধ করে দেয়। ল্যাবরেটরির ফলাফল যা-ই হোক না কেন, সবার একটাই চেষ্টা থাকে প্রচলিত থিওরিতে ফলাফল ব্যাখ্যা করা।
আচ্ছা আইনস্টাইনের জন্ম যদি না হতো তা হলে পদার্থবিদ্যার বর্তমান অবস্থা কী হতো? হেদায়েতের সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। সিগারেটের প্যাকেট হাতের কাছে। বাতি না জ্বালিয়েই প্যাকেট এবং লাইটার খুঁজে বের করা যাবে। ঘরে ঘুটঘুটি অন্ধকার। বাতি জ্বালাতে হলে সুইচবোর্ডও হাতরে হাতরে খুঁজতে হবে। হেদায়েত সামান্য দ্বিধায় পড়ে গেল। সে সুইচবোর্ড খুঁজবে, না সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার খুঁজবে?
হেদায়েত সিগারেটের প্যাকেটের জন্যই ডান হাত বাড়িয়ে খাটের পাশের টেবিল হাতড়াতে শুরু করল। আর তখনি তার হাত হঠাৎ করে অন্য একজনের হাতের উপর পড়ল। নরম মেয়ে মানুষের হাত। সেই হাতের আঙ্গুল আলতো করে চেপে ধরল হেদায়েতের হাতের আঙ্গুল। ঘরে তো আর কেউ নেই। এটা কার হাত? হেদায়েত বিকট চিৎকার দিতে চেষ্টা করল চিৎকার দিতে পারল না। শব্দ গলার কাছে এসে আটকে গেল। হেদায়েত হাত ছাড়াতে চেষ্টা করল। পারল না। হেদায়েতের সমস্ত শরীর হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
এর পরের ঘটনাগুলি কীভাবে ঘটেছে, কোনটার পর কোনটা ঘটেছে— হেদায়েত জানে না। সে শুধু দেখল ঘরের বাতি জ্বলছে। ঘরে কেউ নেই। বাতি সে নিজেই জ্বালিয়েছে এটা নিশ্চিত। কোন হাতে জ্বালিয়েছে ডান হাতে না বাম হাতে?
হেদায়েত সময় দেখল- রাত এগারোটা দুই মিনিট। আজকের তারিখ হচ্ছে তিন। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে—১১ ২ ৩… ফিবোনাক্কি রাশিমালা। ফিবোনাক্কি রাশিমালার বিশেষত্ব হলো— এই রাশিমালার যে-কোনো সংখ্যা
তার আগের দুটি সংখ্যার যোগফল।
হেদায়েতের বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন। খাট থেকে নামতে সাহস হচ্ছে না। কে জানে হাতটা হয়তো খাটের নিচে কোথাও আছে। হেদায়েত খাট থেকে নামমাত্র হাতটা তার পা চেপে ধরবে।
ব্যাপারটা কি স্বপ্নে ঘটেছে? চিন্তা করতে করতে হঠাৎ কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেই জানে না। ভয়ংকর স্বপ্নটা দেখার পর ঘুম ভেঙ্গেছে এবং সে তড়িঘড়ি করে বাতি জ্বালিয়েছে। এত জিনিস থাকতে স্বপ্নে সে হাতটাই বা কেন দেখবে? যুক্তি দাঁড়া করানো যায়। সে সেতুর সঙ্গে আঙটি নিয়ে কথাবার্তা বলেছে। আঙটি আঙ্গুলে পরা হয়। আঙুল থেকে হাত।
যুক্তি দাড়া করাবার পর হেদায়েতের ভয় কিছুটা কমল এবং সঙ্গে তৃষ্ণা অনেক বাড়ল। নাদুর মা খাটের কাছে এক গ্লাস পানি পিরিচে ঢেকে রেখে গিয়েছিল। গ্লাসটা এখনও আছে। পিরিচ দিয়ে ঢাকা। কিন্তু গ্লাসে কোনো পানি নেই। গ্লাসের পানি সে কখন খেয়েছে মনে করতে পারল না।