কে খুন করেছে?
কে খুন করেছে এখনো পরিষ্কার না। ট্রাক ড্রাইভার কুদ্স সম্ভবত খুন করেছে। বাসায় চলে আস বিস্তারিত শুনবে।
ভাবি আমি এক্ষুনি আসছি, আপনি কান্না বন্ধ করেন।
হেনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার স্বামী মারা গেছে আমি কাঁদব না! ঝিম ধরে বসে থাকব! কী রকম কথা বলো!
হেদায়েত তার ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে দেখে প্রচুর লোকজন। হেনা তার আত্মীয়স্বজন সবাইকে খবর দিয়ে এনেছেন। একজন পুলিশ অফিসারও (ধানমণ্ডি থানার সেকেন্ড অফিসার) এসেছেন। পরিমল বাবু পুলিশের সঙ্গে কথা বলছেন। হেনার কথা বলার মতো অবস্থা না। সে কিছুক্ষণ পর পর এলিয়ে পড়ে যাচ্ছে। তার মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে।
সেকেন্ড অফিসার বিরক্ত গলায় বললেন, একজন মানুষের খবর পাওয়া যাচেছ না চব্বিশ ঘণ্টাও পার হয় নাই, আপনারা এরকম কেন করছেন?
পরিমল বাবু বললেন, স্যার, উনি কখনও রাতে ঢাকার বাইরে থাকেন না। নিজের ঘরে না শুলে তার ঘুম আসে না। এই জন্যই দুশ্চিন্তা।
দুশ্চিন্তা দূর করুন। ময়মনসিংহের তার যেসব আত্মীয়স্বজন আছে তাদের বাড়িতে খোঁজ নিন। তাঁর সঙ্গে কি মোবাইল ফোন সেট আছে?
জি স্যার আছে।
টেলিফোন করে দেখেছেন?
জি স্যার। রিং হয় কিন্তু কেউ ধরে না।
আমাকে নাম্বারটা দিন। আমি টেলিফোন করে দেখি! নাম্বার কত?
নাম্বার হেদায়েত বলল। তার সব নাম্বারই মুখস্থ। হেদায়েতের কাছেই জানা গেল যে, তার বড় ভাইয়ের দু’টা মোবাইল সেট। একটা সাধারণ ব্যবহারের জন্যে, অন্যটা শুধু তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য। দুটা নাম্বারেই চেষ্টা করা হলো। রিং হয় কিন্তু কেউ ধরে না।
সেকেন্ড অফিসার বললেন, হয়তো মোবাইল সেট রেখে কোথাও গেছেন। কিংবা সেট দু’টা ছিনতাই হয়েছে। আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। ময়মনসিংহ থানায় আমি খবর দিয়ে দিচ্ছি। ট্রাক ড্রাইভার কুদুসকে বলুন যেন সে তার স্যারের জন্যে অপেক্ষা করে।
হেনা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কুদুসকে এ্যারেস্ট করবেন না?
সেকেন্ড অফিসার বিরক্তি গলায় বললেন, তাকে এ্যারেস্ট করার সময় পার হয়ে যায় নি। অল্পতে অস্থির হবেন না প্লিজ। আমি নিশ্চিত কাল দিনের মধ্যে আপনার স্বামী ফেরত আসবেন।
সাতদিন পার হয়ে গেল, বেলায়েতের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। এখন আর মোবাইলেও কোনো রিং হয় না। হেদায়েত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাইকে খোঁজে। পথে পথে হাঁটে। বেশির ভাগ দিন তার সঙ্গে পরিমল বাবু থাকেন। তিনি অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় খুঁজতে যান। যেমন বুড়িগঙ্গা নদীর নৌকা, নারায়ণগঞ্জ উর্দু বস্তি নামের এক বস্তি।
অদ্ভুত অদ্ভুত কথাও বলেন। যেমন একদিন বললেন, আমার ধারণা স্যার বিবাগী হয়েছেন।
হেদায়েত বলল, বিবাগী কেন হবেন?
সংসারে শান্তি ছিল না। এই জন্যে বিবাগী হয়েছেন। মাডামের সঙ্গে খেঁচাখেছি ছিল। সংসারে শিশু ছিল না। পিতা-মাতা হলো ইট। আর শিশু সিমেন্ট। দুই ইট আটকায়ে রাখে।
হেদায়েত বলল, ভাইজান বিবাগী হয়ে কোথায় যাবেন?
পরিমল বাবু বললেন, আগে বিবাগী হয়ে পুরুষ মানুষ আসাম চলে যেত। কামরূপ কামাক্ষ্যা। এখন পাসপোর্টের ঝামেলার কারণে দেশেই থাকে। সাধারণত পতিতাপল্লীতে আশ্রয় নেয়। মনের মতো মেয়ে খুঁজে বের করে সংসার পাতে।
বলেন কি!
আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দেশের সব কটা পতিতাপল্লীতে অনুসন্ধান করব। নিজেই যাব।
কবে যাবেন?
ঢাকার খোঁজটা শেষ করে শুভদিন দেখে রওনা হব। প্রথম যাব টাঙ্গাইল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পতিতাপল্লী টাঙ্গাইলে। সেখানে কিছু মেয়ে আছে অত্যাধিক রূপবতী। আবার কুহকিনী। মায়াজালে আটকায়ে ফেলে।
মৃত্যু শোক সাতদিনের বেশি স্থায়ী হয় না। কারণ সবাই জানে, যে গেছে সে আর ফিরবে না। নিখোঁজ শোক দীর্ঘস্থায়ী হয়। কারণ একটাই, নিখোঁজ ব্যক্তির ফিরে আসার সম্ভাবনা। আনন্দের সম্ভাবনাই সেখানে শোকের প্রধান কারণ।
স্বামী নিখোঁজ হওয়ায় হেনার বড় ধরনের উপকার হয়েছে। তার শরীর শুকিয়ে গেছে। চেহারায় সৌন্দর্য এবং লাবণ্য ফিরে এসেছে। স্বামীর নানান ব্যবসায় হাল ধরার জন্যেও প্রচুর ছোটাছুটি করছে। বেলায়েতের লোকজন কেউই তাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে না। এই মনকষ্টে সে আরো শুকাচ্ছে।
তার বাড়িতে মুনসি হাফিজ নামের এক মাওলানা স্থায়ী হয়েছেন। তিনি জিন সাধক এবং তার অধীনে সার্বক্ষণিক সঙ্গীর মতো একজন জিনও না-কি থাকে। জিনের নাম হাফসা।
হেনা চেষ্টা করছে হাফসা জিনের মাধ্যমে স্বামীর সংবাদ বের করতে। প্রায় প্রতিদিনই জিনের আসর বসছে।
পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়ছে। রোজই নানান ধরনের লোকজন খোঁজ নিয়ে আসছে। সবার কথাই বিশ্বাস করার মতো। হেনা এদেরকে নিয়েও ব্যতিব্যস্ত। তার এখন নিঃশ্বাস ফেলারও সময় নেই। তাকে দেখে মনে হয় সে আনন্দেই সময় কাটাচ্ছে। হেনা একজন সেক্রেটারি রেখেছে। এম, এ, পাশ সেক্রেটারি। নাম শারমিন। এই সেক্রেটারি পুরুষ হলে মিস্টার বাংলাদেশ হত। এমন পুষ্ট শরীর। সে পেটমোটা চামড়ার ব্যাগ নিয়ে সারাক্ষণই হেনার সঙ্গে আছে।
নতুন করে এডমিনস্ট্রেশন শুরু করতে গিয়ে হেনা কয়েকজনের চাকরি খেয়েছে। তার একজন হচ্ছে পরিমল বাবু। তাঁকে চাকরি চলে যাওয়ায় মোটেই চিন্তিত মনে হচ্ছে না। বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছে বলে তিনি এখন বেলায়েত টিম্বারের অফিসে ঘুমান। তিনি হেদায়েতকে সঙ্গে নিয়ে স্যারকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন এবং একেকদিন একেক গল্প ফাঁদছেন।