বেলায়েতের চোখে পানি আসার উপক্রম হলো। এই না হলে ভাই? বড় ভাইকে মাথা কামাতে দেখেছে বলে সেও মাথা কামাবে। তার ধারণা, কোনো কারণে যদি সে ঝাঁপ দিয়ে ছাদ থেকে রাস্তায় পড়ে হেদায়েতও তাই করবে। ভাইয়ের প্রতি এত শ্রদ্ধা ভক্তি যদিও ঠিক না। বেলায়েত বলল, মাথা কামালে কামা। বাসায় গিয়ে হেভি গোসল দিবি। চুলের কাটা টুকরা গিলা আর বিষ গিলা একই। মাথা কামানোর সিদ্ধান্তটা ভালো নিয়েছিস। মাথা কামাবার। পরপরই মেজাজ অনেকখানি নেমে গেছে। পরিমল বাবুকে আবার চাকরিতে বহাল করব বলে ঠিক করেছি।
ভালো করেছ।
বেলায়েত বলল, মাথা কামানোর পর চল দুই ভাই স্টুডিওতে গিয়ে একটা ছবি তুলে আসি। স্মৃতি থাকুক।
হেদায়েত বলল, আচ্ছা।
সেতু হেদায়েতকে ডিভোর্সের কাগজ পাঠাবে। রবিন একজন লইয়ার নিয়ে এসেছে। কী কারণে ডিভোর্স চাওয়া হচ্ছে তা গুছিয়ে লিখতে হবে। লইয়ার একটা মুশিবিদা তৈরি করে এসেছে। সেখানে লেখা–
“আমার মক্কেল শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতিত। প্রায় দিনই তাকে মদ্যপ স্বামীর কাছে প্রহৃত হতে হয়েছে। এতে সে এখন মানসিক ভারসাম্যহীনতার দ্বার প্রান্তে উপস্থিত। আমার মক্কেলের সন্তানের শখ কিন্তু কিছুতেই তার স্বামী তাকে সন্তান ধারণ করতে দিবে না। এমতাবস্থায় দু’জনের ছাড়াছাড়ি ছাড়া আর করণীয় কিছুই নাই।”
সেতু বলল, এইসব কী হাবিজাবি লিখে নিয়ে এসেছেন? আমার স্বামী জীবনে কখনও আমাকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করে নি। সে কোনোদিন এক ফোঁটা মদ খায় নি অথচ আপনি লিখেছেন মদ্যপ। সে সব সময় বাচ্চা চেয়েছে। আমি চাই নি। একবার কনসিভ করে ফেললাম, তাকে জানিয়ে বাচ্চা Abort করলাম। পরে অবশ্যি তাকে জানিয়েছি। সে কিছুই বলে নি। এমন একজন মানুষ সম্পর্কে কুৎসিত কথা আমি লিখব?
রবিন বলল, এগুলি সবই গৎ বাধা কথা। লিখতে হয় বলে লেখা। নিয়ম রক্ষা। কেউ এইসব বিশ্বাস করে না।
সেতু বলল, কেউ বিশ্বাস না করুক, ও বিশ্বাস করবে। মন খারাপ করবে। আমার মতে যেটা সত্যি সেটাই লেখা উচিত।
রবিন বলল, সত্যটা কী?
সেতু কঠিন গলায় বলল, সত্যিটা হচ্ছে— আমি একজন দুষ্ট স্ত্রী। বেশ্যা টাইপ। আমার মতো স্ত্রীর উচিত না ওর মতো একজন ভালো মানুষের সঙ্গে থাকা।
রবিন বলল, এইসব কী বলছ? তোমার কী মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে!
সেতু বলল, উকিলের মুসিবিদ পড়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এই জাতীয় মিথ্যা আমি তাকে কখনও পাঠাবো না। নেভার। নেভার।
রবিন বলল, চিৎকার করছ কেন? মুসিবিদ অন্যভাবে লেখা হবে। যেমন তোমাদের বনিবনা হচ্ছে না বলে তুমি ডিভোর্স চাচ্ছ।
সেতু বলল, আমাদের বনিবনা হচ্ছে না, এটাও তো ঠিক না। সে আমাকে খুবই পছন্দ করে, আমিও তাকে করি।
লইয়ার বলল, স্যার! আমি বরং অন্য আরেকদিন আসি?
রবিন বলল, অন্য আরেকদিন না। আজই আসুন। সন্ধ্যার পর আসুন। সমস্যা হবে না।
সেতু কঠিন গলায় বলল, তোমার কী ধারণা সন্ধ্যার পর আমি দুই পেগ হুইস্কি খাব, তারপর তুমি যা বলবে আমি তাই করব?
রবিন বলল, না করলে না করবে। এখন চুপ করো। অকারণে চিৎকার করে তুমি আমার মাথা ধরিয়ে দিচ্ছ। চিৎকার করার মতো কিছু হয় নি। Cool down please. কফি খাবে? কফি দিতে বলি?
হেদায়েত বসার ঘরে বসে আছে। তার হাতে টিভির রিমোট। History চ্যানেল বলে একটা চ্যানেলে মিশর নিয়ে কী যেন দেখাচ্ছে। একজন ফারাওদের পোশাক পরে কী যেন বলছে। কোনো কথাই পরিষ্কার না। মনে হচ্ছে লোকটা তোতলাচ্ছে। কোনো ফারাও কি ভোলা ছিল?
নাদুর মা সামনে এসে দাঁড়াল। হেদায়েত বলল, কিছু বলবে নাদুর মা?
নাদুর মা বলল, জি ভাইজান বলব। আমি এইখানে আর কাজ করব না।
হেদায়েত বলল, আগেও তো একবার বলেছ চলে যাবে। যাও নি।
এইবার যাব। নাদুর মা বলল, দুই মাসের বেতন পাওনা আছে। ম্যাডাম জানেন। টাকাটা পাইলে চইলা যাব।
কখন যাবে?
আজই যাওয়ার ইচ্ছা। সইন্ধায় বাস ছাড়ে।
তোমার কত পাওনা হয়েছে?
আটশ টাকা হিসাবে দুই মাসে ষোলশ।
হেদায়েত পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। মানিব্যাগে তিন হাজার টাকা আছে। সে পুরো টাকাটাই নাদুর মার হাতে দিল।
নাদুর মা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল, আপনার খাওয়াখাদ্যের কী ব্যবস্থা হইব ভাইজান?
হেদায়েত বলল, একটা-কিছু ব্যবস্থা হবে। তুমি চিন্তা করবে না।
ম্যাডামের সাথে দুইটা কথা বলতে ইচ্ছা ছিল ভাইজান। টেলিফোনে ধইরা দিবেন?
হেদায়েত অনেক চেষ্টা করল সেতুকে ধরা গেল না। রেকর্ডিং ভয়েস শোনা যায়- “ম্যাডাম দিলরুবা এখন ছবির কাজে ব্যস্ত। পরে যোগাযোগ করুন।” ম্যাডাম দিলরুবাটা কে হেদায়েত বুঝতে পারছে না। সেতু কি তার নাম বদলে দিলরুবা রেখেছে? সেতু নামটাই তো সুন্দর—বন্ধন।
রাত ন’টা। হেদায়েত ৰাসার কাছেই একটা হোটেল থেকে তেহারি খেয়ে এসেছে। চল্লিশ টাকা প্লেট। খাবারটা যথেষ্টই ভালো। রেস্টুরেন্টের মালিকের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তাদের হাউস সার্ভিস আছে। টিফিন ক্যারিয়ারে করে বাসায় খাবার পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা। হেদায়েত তার বাসার নাম-ঠিকানা দিয়ে এসেছে। রেস্টুরেন্টের মালিক বলেছে— খাবার যদি খারাপ পান, পচা-বাসি পান বা ঠাণ্ডা পান বাটা কোম্পানির জুতা দিয়া আমার গালে মারবেন। আমি যদি কিছু বলি তাইলে আমি মানুষের বাচ্চা না, আমি শকুনের বাচ্চা। আমার দোকানের নাম দি গ্রেট বিরানী হাউস বদলায়া রাখব ‘শকুন হাউস’।