সেতু বলল, জুরের অজুহাত দিতে হবে না। তোমার যাবার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি কাল ভোরে দশটা নাগাদ চলে আসব।
আচ্ছা।
ইন্টারকম বাজছে। গাড়ি নিশ্চয় চলে এসেছে। সেতু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ছবিটা ভালো মতো দেখে রাখ। পরে আমাকে গল্পটা বলবে।
আচ্ছা।
ক্ষিধে হলে বুয়াকে বললেই খাবার দিবে। রাতে ডাল-গোশত করা হয়েছে। তোমার ফেবারিট আইটেম।
থ্যাংক য়ু।
হেদায়েত সামান্য ধাঁধায় পড়ে গেল। ডাগ-গোশত তা ফেবারিট আইটেম কেন হবে? কোনো দিন কি বলেছে? বলার কথা না। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আলাপ করতে তার ভালো লাগে না। অংক নিয়ে আলাপ করতে ভালো লাগে। তবে কেউ পছন্দ করে না বলে সেই আলাপও করা হয় না। ম্যাথমেটিশিয়ান ইউলারের একটা গল্প সে অনেক দিন সেতুকে বলতে চেয়েছে। কি করে ইউলার অংক দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, ঈশ্বর আছেন। সেতু গল্পের শুরুতেই বলে, অংক মানসংকের গল্প বন্ধ। অংকের গল্প বলার চেয়ে তুমি বরং আমার গালে একটা চড় দাও।
সেতু চলে গেছে। হেদায়েতের ভালো লাগছে কারণ সেন্টের গন্ধটা এখন আর তাকে কষ্ট দিচ্ছে না। সে হাই তুলতে তুলতে ছবি দেখছে। এখন বড় করেও হাই তুললে সমস্যা নেই। সেতু দেখবে না এবং বলবে না–এত বড় করে হাই তুলছ কেন? আলজিব দেখা যায়। হেদায়েত ছবির গল্পটা মনে রাখার চেষ্টা করছে। কাহিনী কেমন যেন জট পাকিয়ে গেছে। বৃদ্ধ অভিনেতা এখন একটা পাহাড়ি ঝর্নার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে পিস্তল। পিস্তলটা তিনি তার পরনের কালো রঙের সাফারির পকেটে লুকিয়ে রেখেছেন। ঝর্নার পানিতে অতি রূপবতী একজন তরুণী গোসল করছে। বৃদ্ধ এই দৃশ্য আড়াল থেকে দেখছে। রূপবতী তরুণী কে, বৃদ্ধের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী- কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। এদিকে চোখও মেলে রাখা যাচ্ছে না। হেদায়েতের মনে হচ্ছে সে সোফাতেই ঘুমিয়ে পরবে। ঘুমানোর জন্য সোফাটা আরামদায়ক। অনেকখানি চওড়া, নরম গদি। ছুটির দিনে দুপুরে (যে সব দিন সেতু বাসায় থাকে না) হেদায়েত এই সোফায় ঘুমায়।
হেদায়েত সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল কাজের বুয়া নাদুর মা।
ভাইজান! খাবার গরম কইরা টেবিলে দিছি, খাইতে আসেন। চোখে পানি দিয়া আসেন।
নাদুর মা আজ খাব না।
খেয়ে ঘুমাইলে আফা গোস্বা হইব। খাইতে আসেন।
হেদায়েত খেতে বস। ডাল-গোশতের সঙ্গে আলু ভাজি করা হয়েছে। সৃজনে-ডাটা রান্না হয়েছে সরিষা দিয়ে। সজনার বোটানিক্যাল নম গত সপ্তাহে এক পত্রিকায় পড়েছে। নামটা মনে আছে।
নাদুর মা’র রান্না ভালো। বেশ ভালো। তার একটাই সমস্যা–খাওয়ার সময় সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। কেউ আশপাশে থাকলে হেদায়েত খেতে পারে না। সেতুর ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। তবে সেতু বেশির ভাগ সময় সামনে থাকে না।
হেদায়েত সজনা পাতে নিতে নিতে নাদুর মার দিকে তাকিয়ে বলল, সজনার বোটানিক্যাল নাম মোরিঙ্গা অবিফেরা।
নাদুর মা বলল, ও আচ্ছা।
সাধারণত ফলের আকার হয় গোল। আম, জাম, কাঁঠাল, লটকন, জামরুল— সবই গোল কিম্বা গোলের কাছাকাছি। সজনা একটা ফল। এই ফলটা লম্বা।
জ্বি আচ্ছা।
হেদায়েত বলল, কলাও লম্বা ফল। কলার কথাটা মনে ছিল না। সরি!
নাদু’র মা বলল, ভাইজান মাংস নেন।
মাংস নিতে নিতে হঠাৎ হেদায়েতের মনে হলো – সজনা সম্পর্কে সে এত কিছু জানে অথচ নাদু’র মা’র বিষয়ে কিছুই জানে না।
হেদায়েত বলল, তোমাকে আমরা নাদু’র মা বলি, নাদু ছেলে না মেয়ে?
ছেলে।
সে কত বড়?
বড় আছে। গত বছর শাদী করছে।
নাদু করে কী?
রিকসা চালায়। ভাইজান আপনে তারে দেখেছেন। কতবার এই বাড়িতে টাকা নিতে আসছে। আমার বেতনের টাকা সে নেয়। তার সংসারে লাগায়।
ও আচ্ছা।
একবার আপনে তারে একশ’ টেকা দিছিলেন— সিগারেট আনতে। সিগারেট আইনা বিশ টেকা আপনেরে ফিরত দিল। আপনে বললেন, টাকা ফিরত দিতে হবে না। এটা বখশিশ। ভাইজান মনে নাই?
না। ভুলে গেছি।
ভুইলা গেলেন ক্যামনে? টেকা পাইয়া আফনেরে পাও ছুইয়া সেলাম করছে।
খাওয়া শেষ করে হেদায়েত উঠে পড়েছে। নাদুর মার সিগারেট প্রসঙ্গ তোলায় তার ভালো লাগছে। আজ আরাম করে শোবার ঘরে সিগারেট খাওয়া যাবে। বিয়ের পর একদিনও বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাওয়া হয় নি। সেতু সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। তার মাথা ধরে। হেদায়েতকে সিগারেট খেতে হয় বারান্দায়। প্রতিবার সিগারেট খাবার পর ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে হয় এবং গায়ের শার্টটা বদলাতে হয়। সার্টেও নাকি সিগারেটের গন্ধ লেগে থাকে। সেতুর নাক খুব সেনসেটিভ। হেদায়েত একবার রিডার্স ডাইজেস্টে পড়েছিল, যে সব মানুষের নাক সেনসেটিভ হয় তাদের কান কম সেনসেটিভ হয়। প্রকৃতি একটা বেশি দিলে অন্যটা কমিয়ে দেয়। হেমায়েতের কাছে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। মানুষ কৃপণ, প্রকৃতি কৃপণ না।
অনেকদিন পর বিছানায় শুয়ে হেদায়েত পর পর দু’টা সিগারেট খেল। বড় ভালো লাগল। ভালো লাগা এমন এক জিনিস যে একবার শুরু হলে সব কিছুই ভালো লাগতে থাকে। শোবার ঘরের বিছানার চাদরটা দেখতে ভালো লাগছে। অন্যদিন এই চাদরের বড় বড় হলুদ ফুলের রঙ চোখে লাগত। আজ লাগছে না। বৃড় বিছানায় আজ আরাম করে একা ঘুমানো যাবে। এটা ভাবতেও ভালো লাগছে। হেদায়েত ঘুমের মধ্যে খুব নড়াচাড়া করে। সেতুর ঘুম খুব পাতলা বলে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সেতু রাগ করে। আজ হেদায়েত যত নড়াচড়াই করুক সেতুর ঘুম ভাঙ্গবে না।