হেদায়েত চুপ করে আছে। ভাইয়ের দুঃখে বেলায়েতের মন অদ্র। তার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করছে। চোখে পানি চলে আসছে। ভাইয়ের সামনে চোখের পানি ফেলার প্রশ্নই উঠে না। বেলায়েত আলোচনা অন্য খাতে নেয়ার চেষ্টা করল। গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, হাওয়াই মিঠাই বানানোর একটা যন্ত্র। কিনেছি। তোকে দিয়ে দেব। মাঝে মধ্যে হাওয়াই মিঠাই বানাবি।
হেদায়েত বলল, আচ্ছা।
এখন শুধু দুই কালারে বানানো যায়। লাল আর সাদা। তুই চেষ্টা করে দেখ কয়েকটা কালারের করা যায় কি-না। একই ষ্টিকে পাঁচ কালার— সাদা, লাল, সবুজ, হলুদ, নীল।
হেদায়েত বলল, ফুড কালার লাগবে।
বেলায়েত বলল, ফুড কালার তুই ঘুরে ঘুরে জোগাড় করবি। তোর হাতে তো এখন কাজ-কর্ম নাই। তুই বেকার মানুষ।
তা ঠিক।
বেকার বলেছি বলে মনে কষ্ট পাস নাই তো?
না।
অন্য কোনো হোটেলে খান খাবি? চল দুই ভাই মিলে নতুন একটা রেস্টুরেন্টে খানা খাই। দি নিউ দিল্লী হাউস হোটেলের খানা অসাধারণ বলে শুনেছি। পরীক্ষা হয়ে যাক।
হেদায়েত বলল, সেতু আজ নিজের হাতে রান্না করবে। ইটালিয়ান খাবার। বাসায় না খেলে মন খারাপ করবে।
তাহলে বাসায় গিয়ে খা। ভোর এখন প্রধান কাজ স্ত্রীকে তুষ্ট রাখা।
হেদায়েত বলল, তুমি হোটেলে খাও, আমি সামনে বসে থাকব।
বেলায়েতের চোখে আবার পানি আসার উপক্রম হলো। এই না হলে ভাই? বড় ভাই খাবে, সে সামনে বসে থাকবে। রক্তের বন্ধন ছাড়া এই জিনিস কখনও হবে না।
হেদায়েত বাসায় ফিরে দেখে সেতু নেই। চিঠি লেখে চলে গেছে। চিঠিতে লেখা—
হ্যালো পতি!
বিরাট ঝামেলা হয়েছে। রবিন ভাই সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়েছেন। হাতের হাড়ি কনুইয়ের কাছে ভেঙেছে। কম্পাউন্ড ফ্রেকচার। এখন আছেন এ্যাপোলো হাসপাতালে। বেচারা খুবই ভয় পেয়েছে। আমি সান্ত্বনা দেবার। জন্যে যাচ্ছি। রাত দশটার মধ্যে চলে আসব। যদি না আসি, তাহলে বুঝবে আটকা পড়ে গেছি। রবিন ভাইয়ের নিকট আত্মীয় ঢাকায় কেউ নেই। বেচারা অল্পতেই অস্থির হয়ে পড়ে।
তুমি রাতে যা হয় কিছু খেয়ে নিও। নাদুর মাকে বলেছি কষানো মুরগী করতে। আলু চিকণ করে কেটে আলু ভাজি করতেও বলেছি। তোমার তো আলুভাজি পছন্দ। ইটালিয়ান খাবার করতে পারলাম না, সরি।
আরেকটা কথা চাকরি নিয়ে কোনো দুঃশ্চিন্তা করবে না। কোনো একটা ব্যবস্থা হবে।
ইতি
তোমার পত্নী
হেদায়েত ঘড়ি দেখল। সাড়ে দশটা বাজে। সেতু রাতে ফিরবে না। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বড় বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে ঘুমানো যাবে। শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাওয়া যাবে। ভাইজানের কাছ থেকে হাওয়াই মিঠাইয়ের বাক্সটা নিয়ে এসেছে। হাওয়াই মেঠাই বানানো যেতে পারে। ফুড কালার লাগবে। হেদায়েত ডাকল, নাদুর মা!
নাদুর মা বলল, টেবিলে খানা লাগিয়েছি ভাইজান।
হেদায়েত বলল, আজ আর ভাত খাব না। দু’টা হাওয়াই মিঠাই খেয়ে শুয়ে পড়ব।
কী খাইবেন?
হাওয়াই মিঠাই। ক্যান্ডি ফ্লস। আচ্ছা শোনো, হলুদ বেটে কয়েক ফোঁটা হলুদের রস চিপে দিতে পারবে। চেষ্টা করে দেখতাম হলুদ রঙের হাওয়াই মিঠাই করা যায় কি-না।
রাতে সত্যই খাবেন না?
না। তুমি আমাকে কয়েক ফোঁটা হলুদের রস দিয়ে শুয়ে পড়।
নাদুর মা, এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে হতাশা। সে ঠিক করেছে এই বাড়িতে আর কাজ করবে না। চোখের সামনে এত কিছু ঘটতে দেখা ঠিক না।
ভাইজান একটা কথা বলি?
বল।
দেশের বাড়িত জমি নিয়া মামলা-মোকদ্দমা চলতাছে, আমার যাওয়া দরকার।
দরকার হলে অবশ্যই যাবে। কাল সকালে চলে যাও। বেতন যা পাওনা আছে আমাকে বললেই দিয়ে দিব। আমার সঙ্গে টাকা আছে। আজ মাসের এগারো তারিখ কিন্তু পুরো মাসের বেতন পেয়ে গেছি। কাল সকালে যখন যাবে তখন আমার কাছ থেকে কিছু হাওয়াই মিঠাই নিয়ে যেও। বাচ্চাকাচ্ছাদের দেবে। তারা খুশি হবে।
টেলিফোন বাজছে। হেদায়েত টেলিফোন ধরার জন্যে উঠে গেল। রিসিভার কানে লাগিয়ে বলল, কে সেতু?
ওপাশ থেকে বলল, হুঁ।
রবিন সাহেবের অবস্থা কী?
ভালো।
তুমি কি রাতে ফিরবে?
হুঁ।
অনেক রাত হয়ে গেছে। রাতে না ফিরে বরং সকালে ফির। সেটাই ভালো হবে।
ওপাশ থেকে বলল, আচ্ছা স্যার! আপনি কি ম্যাডামের গলাও চেনন না? আমি নীতু।
ও আচ্ছা, তুমি নীতু।
স্যার, আমি সরি বলার জন্যে টেলিফোন করেছি।
সরি বলবে কেন?
ঐ যে মিথ্যা করে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছে আপনার নামে লাগিয়েছি।
মিথ্যা করে লাগালে কেন?
নীতু বলল, আপনাকে আমি টেলিফোন নাম্বার দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আপনি টেলিফোন করবেন। আপনি টেলিফোন করেন না। আমি রোজ রাতে অপেক্ষা করে থাকি। শেষে খুব রাগ উঠে গেল। তখন মিথ্যা করে আপনার নামে লাগিয়েছি। স্যার আপনি কি আমাকে ক্ষমা করেছেন?
হুঁ।
হুঁ না। পরিষ্কার করে বলুন ক্ষমা করেছি।
ক্ষমা করেছি।
আপনার চাকরি চলে যাবার খবর শুনেছি। আমরা খুব হৈচৈ করছি। ধর্মঘট হচ্ছে।
কী জন্যে ধর্মঘট?
আপনাকে যেন আবার নেয়া হয়, এই জন্যে ধর্মঘট।
ও আচ্ছা।
আর আমি প্রিন্সিপাল স্যারকে কী বলেছি জানেন? আমি উনাকে বলেছি – আমার ভুল হয়েছে। অন্য এক লোক টেলিফোন করত। তার গলা হেদায়েত স্যারের মতো। ভালো করেছি না?
বুঝতে পারছি না, ভালো করেছ কি-না। নীতু আমি এখন জরুরি কাজ করছি। টেলিফোনটা রাখি।
এত রাতে কী জরুরি কাজ করছেন?
হলুদ রঙের হাওয়াই মিঠাই বানানোর চেষ্টা করছি।
আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। হলুদ রঙের হাওয়াই মেঠাই কেন বানাবেন?