সে জেগে থাকলে তার সঙ্গে গল্প করবে। আমার ধারণা সে জেগে নেই। রাত ন’টার মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
আজ হয়তো তিনি জেগে আছেন। তুমি ফিরবেন তার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
সেতু বলল, সে কারো জন্যে অপেক্ষা করে না।
রবিন বলল, তুমি এমনভাবে কথাটা বললে যেন এটা বিরাট বড় কোনো গুণ। এটা কোনো গুণ না। আমরা মানুষ। খুবই সামাজিক প্রাণী। আমরা একে অন্যের জন্যে অপেক্ষা করব। এটাই স্বাভাবিক।
সেতু বলল, তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি, সে স্বাভাবিক মানুষ না।
হেদায়েত জেগে ছিল। তার হাতে ডরমিকাম টেবলেট। টেবলেট দু’ভাগ করা হয়েছে। ভাগ সমান হয় নি। একদিকে একটু বেশি হয়েছে, অন্যটা কম হয়েছে। সে বেশিটা খাবে, না কমটা খাবে— এটা বুঝতে পারছে না। সেতুর সঙ্গে পরামর্শ করলে হতো। সেতুকে টেলিফোন করতে ইচ্ছা করছে। না। নাদুর মার সঙ্গে পরামর্শ করা যেতে পারে। অষুধপত্রের ব্যাপারটা মেয়েরা ভালো বুঝে।
হেদায়েত নাদুর মা’কে ডাকতে যাবে তখন দরজা ঠেলে সেতু ঢুকল। বিরক্ত মুখে বলল, এত রাত হয়েছে, সদর দরজা খোলা কেন?
হেদায়েত বলল, তুমি আসবে এই ভেবেই হয়ত নাদুর মা খোলা রেখেছে।
সেতু বলল, রনি ভাই আমার সঙ্গে এসেছেন। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করবেন। চা খাবেন। বসার ঘরে চল। শার্ট গায়ে দিয়ে আস। একজন গেস্টের সাথে কথা বলবে খালি গায়ে! তুমি কথা বল। আমি গোসল করে ড্রেস চেঞ্জ করে তোমাদের সঙ্গে জয়েন করব।
হেদায়েত রবিন ভাইকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। অতি রূপবান একজন মানুষ। বয়স পঞ্চাশের উপর। মাথা ভর্তি সাদা-কালো চুল। বড় বড় চোখ। হাসি হাসি মুখ। রবিন হেদায়েতকে দেখে প্রথমেই বললেন, ভাই আপনার ফ্ল্যাট কি স্মোক ফ্রি জোনে? আজকাল বেশির ভাগ বাড়িই স্মোক ফ্রি। সিগারেট খেতে হলে ছাদে উঠতে হয়।
হেদায়েত বলল, আপনি সিগারেট খান। শুধু আমাদের শোবার ঘরে সিগারেট খাওয়া নিষেধ।
রবীন বললেন, আমি ভাগ্যবান যে আমাকে শোবার ঘরে বসানো হয় নি।
নাদুর মা চা নিয়ে এসেছে। তার চা বানাতে এক মিনিটেরও কম সময় লাগে। চুলায় ফুটন্ত পানির কেটলি থাকে। কেউ চা চাইলে কাপে পানি ঢেলে টি ব্যাগ দিয়ে নিয়ে আসা।
রবিন বললেন, সেতুর কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। ইদানীং নাকি রাতে ভূত দেখছেন। মেয়ে ভূত।
হেদায়েত বলল, ভূত ঠিক না। একটা হাত দেখি। দেখিও ঠিক না। আমার কাছে মনে হয় একটা হাতের উপর আমার হাত পড়েছে। মেয়েদের হাতের মতো নরম হাত।
রবিন বললেন, নেট টাইম হাতে একটা ভোলা সেফটিপিন নিয়ে ঘুমাবেন। যেই হাতের উপর হাত পড়বে ওমি সেফটিপিনের সূচ ভাবিয়ে দেবেন।
হেদায়েত বলল, কাজটা ঠিক হবে না।
ঠিক হবে না কেন?
হাতটা তো আমার কোন ক্ষতি করছে না। আমি শুধু শুধু কেন তাকে ব্যাথা দেব?
রবিন বললেন, আমি ঠাট্টা করছিলাম। আপনার যা দরকার তা হলো একজন ভালো নিউরোলজিস্টের সঙ্গে কথা বলা। আমার ধারণা আপনার সমস্যাটা নিউরোলজিক্যাল। নিউরোলজির এক্সপার্ট আমার একজন ভালো বন্ধু আছেন। তাকে দেখাবেন? অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেব।
হেদায়েত বলল, সমস্যাটা যদি আরো বাড়ে তা হলে আপনাকে বলব।
রবিন বললেন, এই জাতীয় সমস্যা বাড়তেই থাকে কখনও কমে না। কাজেই শুরুতেই টেক কেয়ার করা উচিত। ভাই আমি উঠি।
সেতু তো এখনও বাথরুম থেকে বের হয় নি।
রবিন বললেন, আমি তো সেতুর সঙ্গে কথা বলতে আসি নি। তার সঙ্গে তো প্রায়ই কথা হয়। আমি কথা বলতে এসেছিলাম আপনার সঙ্গে। কথা শেষ হয়েছে, কাজেই বিদায়। নিউরোলজিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আপনাকে খবর দেব। চায়ের কাপে অনেকখানি চা ছিল। রবিন এক চুমুকে চা শেষ করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
সেতুর গোসল করতে অনেক সময় লাগে। বাথটাবে অনেকক্ষণ পা ডুবিয়ে বসে না থেকে সে গোসল করতে পারে না। গা ডুবিয়ে বসে থাকার সময় তার গান শুনতে হয়। বাথরুমে গান শোনার ব্যাবস্থা আছে। সেতু কিছু পছন্দের গান এই সময় শুনে। পছন্দ ঘন ঘন বদলায়। এখন স্নান সঙ্গীত হিসেবে তার পছন্দ হলো— নদীর নাম ময়ূরাক্ষী কাক কালো তার জল। গানের একটা লাইনে আছে— ‘কোনো ডুবুরী সেই নদীটির পায় নি খুঁজে তল। এই লাইন আসা মাত্র সে বাথটাবের পানিতে মাথাটা পুরোপুরি ডুবিয়ে দেয়। ভাবটা এরকম যেন সে ময়ূরাক্ষী নদীর তল খোঁজার চেষ্টা করছে।
গায়ে টাওয়েল জড়িয়ে সেতু বাথরুম থেকে বের হলো। হেদায়েত বলল, তোমাকে খুব পবিত্র লাগছে।
সেতু বলল, পবিত্র লাগছে মানে কী?
হেদায়েত বলল, মানে গুছিয়ে বলতে পারব না। তবে তোমাকে দেখে নিজের মধ্যে পবিত্র ভাব হচ্ছে। তুমি গায়ে ধবধবে সাদা একটা টাওয়েল
জড়িয়ে আছ, এই জন্যেও হতে পারে। সাদা পবিত্রতার রঙ।
সেতু বলল, অপবিত্রের রঙ কোনটা? আমি যদি গায়ে কালো রঙের টাওয়েল জড়াই তা হলে কি আমাকে অপবিত্র দেখাবে?
জানি না।
সেতু বলল, কালো রঙের টাওয়াল গায়ে জড়াচ্ছি। ভালো করে দেখে বল অপবিত্র লাগছে কি-না।
সেতু কালো টাওয়েল গায়ে জড়ল। হেদায়েত বলল, এখনও পবিত্র লাগছে।
তাহলে তো ভালোই। আমাকে চা দিতে বল। চা খেয়ে পবিত্র অবস্থায় ঘুমুতে যাব। অষুধ খেয়েছ?
অর্ধেকটা খেয়েছি। কম অর্ধেকটা।
এতেই হবে। কিছুক্ষণ গল্প করে ঘুমাতে যাবো। অনেকদিন তোমার সঙ্গে গল্প করা হয় না। সুন্দর একটা গল্প রেডি কর।
ম্যাথমেটিসিয়ান এবেলিয়নের গল্প শুনবে?