মতি মিয়া বলল, বাজারে মেয়েমানুষ ছাড়া কি হাট জমে, কও দেহি? এর মইধ্যে একটার নাম ফুলন। কাঁচা হলদির লাহান গায়ের চামড়া। আর চুল কী!
তুমি অত কিছু জানলা ক্যামনে? আহু, দেখলাম। দূর থাইক্যা দেখলাম। তুমি কি ভাবছ, গেছিলাম? মালুদে এলাহী।
চা গলায় লেগে মতি মিয়া বিষম খেল।
মেয়ে তিনটি নৌকা নিয়ে এসেছে। সেজেগুজে নৌকার সামনে বসে আছে দু জন। আমিন ডাক্তার অবাক হয়ে দেখল, একটি মেয়ে সত্যি অপূর্ব। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে দেবীপ্রতিমার মতো লাগছে। মতি মিয়া আমিন ডাক্তারের হাতে একটি মৃদু চাপ দিয়ে বলল, উখ ট্যারা হইয়া যায়, কী কও ডাক্তার? ফুলনের আরেকটা নাম হইল গিয়া তোমার পরীবানু।
তুমি জানলা ক্যামনে?
হুনছি। হুনা কথা।
উত্তর বলে নেমে মতি মিয়া গুনগুন করে গান ধরল,
ও কইন্যা সোনার কন্যা রে
ও কইন্যা রূপের কন্যা রে
…. … … … …
মতি মিয়ার গলা ভালো, আমিন ডাক্তারের মনটা উদাস হয়ে গেল।
কাল সারা রাত শরিফার ঘুম হয় নি
কাল সারা রাত শরিফার ঘুম হয় নি।
ইদানীং প্রায়ই এরকম হচ্ছে। সারা রাত এ-পাশ ও-পাশ করে কাটে। পাশেই মতি মিয়া গাছের মতো ঘুমায়। শরিফার অসহ্য বোধ হয়। কাল রাতে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত গায়ে ধাক্কা দিয়ে মতি মিয়ার ঘুম ভাঙাল। মতি মিয়া ঘুম
জড়ান স্বরে বলল, কী হইছে?
বাংলাঘরে কী যেন শব্দ করে। মনে লয় চোর আইছে।
আছে কী আমার, চোর আইব? ঘুমাও।
দেইখ্যা আও না।
মতি মিয়া ঘুরে এল, কোথায়ও কিছু নেই, খা-খাঁ করছে চারদিক।
মতি মিয়া ফিরে এসেই ঘুমিয়ে পড়ল। আবার তাকে শরিফা ডেকে তুলল, আমার পিছনবাড়িত যাওন লাগব।
যাওন লাগব–যাও।
একলা যাই ক্যামনে?
দুত্তোরি মাগী। ঘুমাইতে যাওনের আগে সব শেষ কইরা আইতে পারছ না?
থাউক, যাওন লাগত না।
মতি মিয়া আবার ঘুমিয়ে পড়ল। শরিফা খুনখুন করে কাঁদতে শুরু করল। লোকটা এই রকম কেন? এমন ভাব করছে, যেন শরিফা একটা কাঠের পুতলী। ছেলেগুলিও দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। নুরুদ্দিন তো তাকে সহ্যই করতে পারে না। রাতদিন রহিমার পিছে পিছে ঘুরঘুর করে। এক দিন সে গোসা করেছে, ভাত খায় না। কত সাধাসাধি। মতি মিয়া বলল, আজরফ বলল, এমন কি আমিন ডাক্তার পর্যন্ত সাধ্যসাধনা করল। খাবেই না, শেষটায় রহিমা গিয়ে বলল, বাপধন খাও, খালার পাতে চাইর খাও।
অমনি সুড়সুড় করে খেতে বসল। যেন কিছুই হয় নি।
এই সব কথা মনে এলে চোখে পানি আসে। শরিফা ফুঁপিয়ে উঠল।
এই, কাল ক্যান? কান্দি না। ফোসফোস করতাছ ক্যান?
শরিফা ধরাগলায় বলল, আমি বাপের বাড়িত গিয়া কয়েকটা দিন থাকতাম চাই।
বাপের বাড়িত আছে কেডা?
ভাই আছে।
ভাই?
গলা ফাটিয়ে মতি মিয়া হাসল, এই সব চিন্তা ছাড়া দেও। অত যে ঝামেলা গেছে, তোমার গুণের ভাই একটা খোঁজ নিছে? কও, নিছে খোঁজ?
শরিফা মিনমিন করে কী বলল ঠিক বোঝা গেল না।
চিল্লাচিল্লি বন্ধ কইরা কাজ-কাম কর।
আমি চিল্লাচিল্লি করি?
না, তুমি তো নয়া কইন্যা। মুখের মধ্যে একটা কথাও নাই।
শরিফা আজকাল অবশ্যি খুবই চেঁচামেচি করে। রহিমার সঙ্গে আকাশ ফাটিয়ে ঝগড়া করে। এইডা কী রানছে, ও রহিমা ওয়াক থু। হলুদের গন্ধে মুখে দেওন যায় না। হলুদ সস্তা হইছে? বাপের বাড়ির হলুদ পাইছ? ঝাঁটা দিয়া পিটাইয়া এই সব আপদ দূর করা লাগে।
সামান্য জিনিস থেকে কুরুক্ষেত্র ঘটে যায়। শুধু তাই নয়, সুযোগ পেলেই রহিমার মেয়েটাকে সে মারধোরও করে। মেয়েটাও মার মত চুপচাপ। মার খেয়েও শব্দ করে না। এক-একা পুকুর পাড়ে বসে থাকে। শরিফার অসহ্য বোধ হয়। কাউকেই সহ্য করতে পারে না। আমিন ডাক্তারের সঙ্গেও ঝগড়া করে। ঝগড়া করে ক্লান্ত হয়ে এক সময় সে কাঁদতে শুরু করে। আমিন ডাক্তার বিব্রত হয়ে বলে, কান্দনের কী হইল, ও দোস্তাইন?
আমারে বিষ আইন্যা দিয়েন।
কী ধরনের কথা কনা না দোস্তাইন, বাজে চিন্তা বাদ দেওন দরকার।
ধানকাটা শুরু হবার আগে মতি মিয়া মোহগঞ্জে চলে যাবে। রূপকুমারী যাত্ৰা পার্টির অধিকারী লোক পাঠিয়েছে। শরিফা আকাশ থেকে পড়ল, অখন তুমি যাইবা ক্যামনে, ধান কাটব কে?
আজরফ কাটব।
কও কী তুমি। আজরফ দুধের পুলা।
চুপ কর, খালি চিল্লায়।
মতি মিয়া গম্ভীর মুখে কাপড় গোছায়। শরিফা নুরুদ্দিনকে পাঠায় আমিন ডাক্তারকে ধরে আনতে। আমিন ডাক্তার আসতে পারে না। দীর্ঘ দিন পর তাকে নেবার জন্যে সুখানপুকুর থেকে নৌকা এসেছে। রুগী মরণাপন্ন, এখনি রওনা হওয়া প্রয়োজন।
নুরুদ্দিন, তর বাপরে ধরা-বাইন্ধা রাখ, আমি আইতাছি রাইতে–বুঝছস?
বুঝছি।
লোকটার মাথা খারাপ, এই সময় কেউ যায়? নৌকা ছাড় গো তোমরা।
নৌকা ছেড়ে দেওয়ার সময় আমিন ডাক্তার আরেক বার গম্ভীর হয়ে বলে, দুই টেকা ভিজিট, অষুধ ভিন্ন। আর নৌকা দিয়া ফিরত দিয়া যাইবা। সুখানপুকুর পৌঁছতে পেঁছতে রাত পুইয়ে যায়। নৌকা থেকে নেমে মাইল পাঁচেক হাঁটতে হয়। অসম্ভব কাদা এই অঞ্চলে। বড়োই কষ্ট হয় হাঁটতে। কোথাও থেমে যে বিশ্রাম নেওয়া হবে, সে উপায় নেই। রুগীর বাবা ঝড়ের মতো ছুটছে, বারবার বলছে, পা চালাইয়া হাঁটেন ডাক্তার সাব।
বাড়ির সামনে মুখ লম্বা করে সিরাজুল ইসলাম বসে ছিল। আমিন ডাক্তারকে দেখে গম্ভীর মুখে বলল, আপনাকেও এনেছে দেখি। হুঁ, আর কাকে আনবে?
রুগীর বাবা পা দেওয়ার পানি আনতে গেছে, এই ফাঁকে সিরাজুল ইসলাম গলা নিচু করে বলল, ডাক্তার পিষে খাওয়ালেও কিছু হবে না। শেষ অবস্থা। আর এমন চামার, বুঝলেন। দু টাকা দেওয়ার কথা দিয়েছে এক টাকা। মাছের বাজার আর কি।