এটি যেন তার নিজের বাড়ি নয়। যেন সে বেড়াতে এসেছে। পাড়া-প্রতিবেশী বৌ-ঝিরাও কেমন যেন সমীহ করে কথা বলে। একটু দূরত্ব রেখে বসে। নানান কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে, কাটা পাওড়া কই ফালাইয়া আসছ?
শরিফার অসহ্য বোধ হয়। সরু গলায় বলে, হাসপাতালেই রাইখ্যা আইলাম। সাথে আইন কী করবাম?
নইমের বৌ ভীত স্বরে বলে, পাওডারে কবর দিছে?
শরিফার কাঁদতে ইচ্ছা করে। এক পা নিয়ে কাজকর্ম সে কিছুই করতে পারে না। সারা সকাল লেগে যায় ভাত ফোটাতে। থালাবাসন থোবার জন্যে আজরফকে কলসি দিয়ে পানি এনে দিতে হয়। হাসপাতালে থাকার সময় এই সব ঝামেলার কথা তার মনে হয় নি।
আমিন ডাক্তার সব দেখেশুনে গম্ভীর হয়ে বলল, রহিমারে খবর দিয়া আনা দরকার দোস্তাইন।
না।
কিছু দিন সে থাকুক।
কইলাম তো না।
সুবিধার লাগি না কইতাছি।
আমার সুবিধা দেখনের দরকার নাই।
শরিফা কাঁদতে শুরু করল। তার একটি নতুন উপসর্গ যোগ হয়েছে। প্রায়ই যে কোনো প্রসঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করে শেষ পর্যায়ে কাঁদতে শুরু করবে।
দোস্তাইন, কান্দনের কারণ তো কিছু নাই।
যার আছে হে বুঝে।
ইদানীং শরিফার মনে ধারণা হয়েছে, মতি মিয়া তাকে এখন আর দেখতে পারে না। গত রাত্রে মতি মিয়া বারান্দায় বসে ছিল। শরিফা তিন বার গিয়ে ডাকল। তিন বারই সে বিরক্ত হয়ে বলল, ঘুমাইবার সময় হউক, সন্ধ্যা রাইতেই ডাক ক্যান? আমি তো নয়া সাদি করি নাই, সন্ধ্যা রাইতেই ঘরে খিল দেওনের যোগাড় করবাম।
কী কথার কী জবাব। শুধু মতি মিয়া নয়। আজরফ পর্যন্ত তার কথার জবাব দেয় না। এক কথা দশ বার জিজ্ঞেস করতে হয়।
এক দিন দেখা গেল আজরফ বাঁশ আর চাটাই দিয়ে ঘরের লাগোয়া নতুন একটা চালাঘর তুলছে। নুরুদ্দিন মহা উৎসাহে এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। মতি মিয়া ইকা হাতে দাওয়ায় বসে তদারক করছে। ঘরে নতুন কাজকর্ম হলে আজকাল আর কেউ শরিফাকে কিছু জিজ্ঞেস করে না। শরিফা মুখ কালো করে বলল, আজরফ ঘর তুলতাছস ক্যান?
আজরফ জবাব দিল না। যেন শুনতেই পায় নি।
আজরফ, নয়া ঘর তুলনের দরকারডা কী?
জবাব দিল মতি মিয়া, পুলাপান বড় হইতাছে, একটা ঘর তো দরকার। শরিফা লক্ষ করল, নুরুদ্দিন মুখ টিপে হাসছে।
বিষয়টা কী, নুরা?
নুরুদ্দিন দাঁত বের করে হাসল। ঘর উঠছে রহিমা খালার লাগি। রহিমা খালা আর অনুফা থাকব।
শরিফা স্তম্ভিত হয়ে গেল। মতি মিয়া থেমে থেমে বলল, তোমার সুবিধা হইব খুব। ঘরের কাজকাম দেখব।
আমি বাইচ্চা থাকতে এই বাড়িত কেউ আসত না।
মতি মিয়া বলল, আইজ সন্ধ্যায় আইব, খামাখা চিল্লাইও না।
আমি গত দড়ি দিয়াম কইতাছি।
মতি মিয়া গম্ভীর হয়ে ডাকল, আজরফ।
জ্বি।
তোর মারে বালা দেইখ্যা একটা দড়ি দে দেহি।
রহিমা সত্যি সত্যি সন্ধ্যা নাগাদ এসে পড়ল।
সে তার যাবতীয় সম্পত্তিও সঙ্গে এনেছে। একটি টিনের ট্রাঙ্ক, ছয়-সাতটি হোট-বড়ো পুঁটলি, হাঁড়ি-ডেকচি। অনুফার হাতে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা ছাগল। রহিমা শরিফার ঘরে ঢুকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, বুজির শইলডা বালা?
শরিফা কোন কথা বলল না। রাতে খাওয়ার সময় বলে পাঠাল তার খিদে নেই। অনেক রাত্ৰে ৰূপৰূপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। শরিফা শুনল, নতুন চালাঘরে খুব হাসাহাসি হচ্ছে। মতি মিয়া কী-একটা বলছে, সবাই হাসছে। সবচেয়ে উঁচু গলা হচ্ছে নুরুদ্দিনের।
অনেক রাত্রে মতি মিয়া যখন ঘুমোতে এল, শরিফা তখনো জেগে। কুপি নিভিয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে শরিফা ক্ষীণ স্বরে বলল, একটা কথার সত্যি জবাব দিবা?
কী কথা?
তুমি কি রহিমারে বিয়া করতে চাও?
মতি মিয়া দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে বলল, হ।
তুমি রহিমারে এই কথা কইছ?
না। আমিন ডাক্তার কইছে রহিমার মত নাই। তার ধারণা মনু বাইচ্চা আছে।
মতি মিয়া হঁক ধরাল। শরিফা ধরাগলায় বলল, বিয়াটা কবে?
মত না থাকলে বিয়াটা হইব কেমনে?
আইজ মত নাই, এক দিন হইব।
মতি মিয়া নিৰ্বিকার ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল। অরক্ষণের মধ্যেই তার নাক ডাকতে লাগল। শরিফা সারা রাত জেগে বসে রইল।
গোটা জ্যৈষ্ঠ্যমাসে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয় নি
গোটা জ্যৈষ্ঠ্যমাসে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয় নি।
বৃষ্টি-বাদলা না হলে জ্বরজারি হয় না। রুগীপত্র নেই, আমিন ডাক্তার মহা বিপদে পড়ে গেল। হাত একেবারে খালি। চৌধুরীবাড়িতে ত্রিশ টাকা কর্জ হয়েছে। গত বিশ দিনে রুগী এসেছে মাত্র একটি। সুখানপুকুরের অছিমুদ্দিনের মেজ ছেলে। ভিজিটের টাকা দূরে থাক, ওষুধের দামটা পর্যন্ত পাওয়া গেল না। অজিমুদ্দিন নিমতলির পীর সাহেবের নামে কিরা কেটেছে হাটবার দিন সকালবেলা এসে দিয়ে যাবে। নিমতলির পীর জ্যান্ত পীর। তার নাম নিয়ে টালবাহানা করা যায় না। কিন্তু অজিমুদ্দিন লোকটি মহা ধুরন্ধর। আজ নিয়ে তিন হাট গেল, তার দেখা নেই।
আমিন ডাক্তার শুকনো মুখে সারা হাট খুঁজে বেড়ায়। হাটের দিন চাষাভূষাের মত থাকা যায় না। দশ গ্রামের লোকজন আসে। নতুন মানুষদের সঙ্গে আলাপপরিচয় হয়। কাজেই হাটবারগুলিতে আমিন ডাক্তার একটু বিশেষ সাজসজ্জা করে। আজকে দেখা গেল আমিন ডাক্তারের গায়ে এই গরমেও একটি লাল কোট। হাতে ডাক্তারী ব্যাগটা কায়দা করে ধরা। ব্যাগটিতে ইংরেজি লেখা–
ডক্টর এ রহমান
প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার
আমিন ডাক্তারের চোখে নিকেলের চশমা। লোকজন ঠাহর হয় না। বারবার দেখতে হয়। অজিমুদ্দিনের মেছোহাটায় থাকার কথা। সেখানে পাওয়া গেল সিরাজুল ইসলামকে। সিরাজুল ইসলাম নিমতলির ডাক্তার। সমগ্র ভাটি অঞ্চলে তার নামী ডাক্তার হিসেবে খ্যাতি। লোকটি ছোটখাট, টেনে টেনে অত্যন্ত কায়দা করে কথা বলে। সিরাজুল ইসলাম আমিন ডাক্তারকে দেখামাত্র একগাল হেসে বলল, এই গরমের মধ্যে এমন কোট। সগিমি হয়ে মরবেন, বুঝলেন?