কিন্তু সেই বৎসর খুব কাজে ফাঁকি দিল। চৌধুরীদের তখন জালা বোনা হচ্ছে। দম ফেলার সময় নেই। কাজে বিরাম দিয়ে এক দণ্ড যে কা টেনে শরীর গরম করবে, সে অবসরটাও নেই। এর মধ্যেই দেখা গেল মনু উধাও। অন্য মনিব হলে কী হত বলা যায় না, চৌধুরী সাহেব বলেই দেখেও দেখেন না। পুরুষ মানুষ দিনেদুপুরে বাড়ি এসে বৌয়ের সঙ্গে গল্প, কী লজ্জার কথা রহিমা শরমে মরে যায়। কিন্তু লোকটার লাজলজ্জার বালাই নেই। এক রাত্রে রহিমাকে জোর করে নৌকায় তুলে বড়ো গাঙ পর্যন্ত চলে গেল। চাঁদনি রাতে নৌকা বাওয়ার মধ্যে খুব নাকি আনন্দ। আনন্দ ছিল ঠিকই। নদীর জলে ভেঙে-পড়া জ্যোঙ্গা, দূরের বিল থেকে ভেসে আসা হত হত শব্দ, দুই পাশে গাছগাছালির গায়ে মাখা অদ্ভুত এক জ্যোভেজা অন্ধকার। কী যে ভালো লেগেছিল রহিমার। এর মধ্যে ঐ লোক আবার ভাঙা গলায় গান ধরল। সুর তাল কিছুই নেই, তবু সেই গান শুনে বারবার চোখ ভিজে উঠল রহিমার।
মানুষটি বড়ো সৌখিনদার ছিল। দু টাকা দিয়ে এক বার এক গায়ে-মাখা সাবান কিনে আনো। কী বোটকা গন্ধ! গা বমি-বমি করে। আরেক বার কিনল হাঁটু পর্যন্ত উঁচু রবারের জুতো। এই প্যাক-কাদার দেশে কেউ জুতো কেনে? সরকারবাড়ির নেজাম সরকার পর্যন্ত খালি পায়ে মাঠে যান ক্ষেত দেখতে। জুতো কেনার পর থেকে মচমচ শব্দে লোকটা শুধু হাঁটে। চৌধুরী সাহেব এক দিন ডেকে বললেন, টেকা পয়সা জমাইবার অভ্যাসটা কর মন। নিজের একটা বাড়ি-ঘর। বিয়া-সাদি করছস, দায়দায়িত্ব আছে। খামাখা এই জুতা কিলি ক্যান?
জুতাডা চদরী সাব হস্তায় পাইছি। খুব কামের। পানির মইধ্যে হারা দিন থাকলেও এক ফোডা পানি ঢুকত না।
এই সব ধান্ধা বাদ দে মনু।
লোকটার স্বভাব তবু বদলায় না। ভাদ্র মাসে ছাতা কিনে ফেলল একটা। বাহারী ছাতা। বাঁটের মধ্যে হরিণের মুখ। বড়ই রাগ হয় রহিমার। কিন্তু কার উপর রাগ করবে? এই লোক কি রাগ-টাগ কিছু বোঝে? চৌধুরী সাহেব খুব বিরক্ত হন।
বৃষ্টি-বাদলা কিছু নাই। শুকনা দিন। মাথার মইধ্যে ছাতি কেন রে মনু?
নয়া কিনছি চদরী সাব। পাইকারি দরে দিছে।
তোর কপালে দুঃখু আছে মনু।
হা হা করে হাসে মনু। যেন ভারি একটা মজার কথা শুনল।
সেই লোক কোথায় যে হারিয়ে গেল।
গয়নার নৌকায় মোহনগঞ্জ গিয়েছে, পর দিন ফেরার কথা। আর ফেরে নি। দেখতে দেখতে মাস শেষ হল। কোনো খোঁজই নেই। কী কষ্ট, কী কষ্ট। অনুফা তখন পেটে। রাতের পর রাত জেগে বসে থাকে রহিমা। খুট শব্দ হলেই লাফ দিয়ে ওঠে, এল বুঝি। কত রকম উড়ো খবর আসে। এক বার শুনল, বাজারের একটা মেয়েমানুষের সঙ্গে থাকে। সেই মেয়েমানুষটা চোখে সুরমা দেয়, ঘাগরা পরে। আবার এক বার শুনল, আসাম গেছে। আসামে কাঠের ব্যবসা করে।
হয়তো তাই এক দিন টাকাপয়সা নিয়ে গভীর রাতে রবারের জুতোয় মসমস শব্দ করে লোকটা উপস্থিত হবে। রহিমা যত রাগই করুক, লোটা গলা ফাটিয়ে হাসবে হা হা হা।
বৈশাখ মাসে অনুফার জন্ম হল। চৌধুরী সাহেব বললেন বাচ্চা নিয়ে তাঁর বাড়িতে এসে থাকতে। রহিমা রাজি নয়। হঠাৎ যদি কোন দিন লোকটা এসে উপস্থিত হয়, তখন?
গাঁয়ের সবাই সাহায্য করেছে। চাল-ডাল তরিতরকারি–অভাব কিছুরই হয় নি। চৌধুরী সাহেব মেয়ের মুখ দেখে ২০টি টাকা দিলেন। আমিন ডাক্তারের মতো হতদরিদ্র লোকও পাঁচটি টাকা দিয়ে গেল।
অনুফা একটু বড় হতেই অন্য রকম ঝামেলা শুরু হল। গভীর রাত্রে ঘরের পাশে কে যেন হাঁটাহাঁটি করে, খুটখুট করে দরজায় শব্দ। ভয়ে কাঠ হয়ে থাকে রহিমা।
কে গো, কেডা?
আর কোনো সাড়া নেই। শেষ পর্যন্ত যেতে হল সুরুজ মিয়ার বাড়ি। চৌধুরী সাহেবের ওখানে যেতে সাহসে কুলোয় না। হোট চৌধুরী পাগল মানুষ। কোনো কোনো সময় দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে রাখতে হয়।
সুরুজ মিয়ার স্ত্রটি চিরগ্ণা। তার দু বছরের ছেলেটিও সেরকম। রাত-দিন ট্যা-ট্যা করে কাঁদে। রহিমার নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসূত রইল না। ধান কাটার সময় তখন। সুরুজ মিয়া অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ। তিন-চার জন উজানদেশী জিরাতি কামলা তার। সকাল থেকে দুপুর রাত পর্যন্ত খাটাখাটনি করতে হয় রহিমাকে। খারাপ লাগে না। কিন্তু এক গভীর রাত্রে সুরুজ মিয়া এসে তার ঘরে ঢুকে পড়ল। স্তম্ভিত রহিমা কিছু বুঝবার আগেই সুরুজ মিয়া তার মুখ চেপে ধরল, শব্দ কইর না, মাইয়া জাগব।
মেয়ে অবশ্যি জাগল না। এক সময় অন্ধকার ঘরে বিড়ি ধরাল সুরুজ মিয়া। ফিসফিস করে বলল, পাপ যা হণ্ডনের, হে তো আমার হইল–তুমি কাল ক্যান? শরীরের মইধ্যে কোনো দোষ লাগে না। বুঝছ?
রহিমা চলে এল চৌধুরীবাড়ির অন্ধকার কোঠায়। ঘোট চৌধুরী লাল চোখে ঘুরে বেড়ায়। রহিমার আর ভয় লাগে না। অনুফাকে মাঝে মাঝে তাড়াও করে। অনুফা খেলা মনে করে খিলখিল করে হাসো হোট ছৌধুরী চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, হাসিস না হারামজাদী বিন্দু। খবরদার, হাসিস না।
এক সময় সেই লোকটির চেহারাও রহিমার মনে রইল না। মাঝে মাঝে খুব যখন ঝড়-বৃষ্টি হয়, বিলের দিক থেকে শী-শী শব্দ ওঠে–তখন ভাবতে ভালো লাগে লোকটা রবারের জুতো পায়ে দিয়ে মচমচ করে যেন এসেছে। অসম্ভব তো কিছুই নয়। হারিয়ে যাওয়া মানুষ তো কতই ফিরে আসে।
কিংবা কে জানে সেই লোকটি হয়তো কোন এক ভিন দেশে গিয়ে আমিন ডাক্তারের মতো মহাসুখে আছে। আমিন ডাক্তার যেমন এক দিন গয়নার নৌকায় করে সোহাগীতে উপস্থিত হল, তারপর আর যাওয়ার নাম করল না। কে জানে সেও উজান দেশে তার বৌ-মেয়ে ফেলে এসেছে কিনা। হয়তো তারাও অপেক্ষা করে আছে কবে ফিরবে আমিন ডাক্তার। রহিমার বড়ো জানতে ইচ্ছে করে।
শরিফার কিছুই ভালো লাগে না
শরিফার কিছুই ভালো লাগে না।