রহিমা মেয়েটি অবশ্য খুবই কাজের। এই কয় দিনেই সে বাড়ির চেহারা পাল্টে ফেলেছে। পুবের ঘরের সামনে আগাছার যে-জঙ্গল ছিল তার চিহ্নও নেই। চার-পাঁচটা কাগজি লেবুর কলম লাগিয়েছে সারি করে। বাড়ির পেছনের রান্নার জায়গাটা দরমা দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। ঘাটে যাওয়ার পথটায় সুন্দর করে ইট বসান। ইটগুলি যোগাড় হয়েছে কোত্থেকে কে জানে? মতি মিয়ার ইচ্ছা করে রহিমাকে এই বাড়িতেই রেখে দিতে। শরিফার ঘরের লাগোয়া একটা ছোটমধ্যে চালাঘর তুলে দিলেই হয়। শরিফা কিন্তু রাজি হবে না। কেঁদেকেটে বাড়ি মাথায় করবে। কারণ রহিমার বয়স অল্প এবং সে সুন্দরী। একটি সুন্দরী এবং অল্পবয়েসী। মেয়েকে জেনেশুনে কোনো বাড়ির বৌ নিজের বাড়িতে রাখবে না।
জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি আমিন ডাক্তার নৌকা নিয়ে উপস্থিত। তাকে আর চেনার উপায় নেই। গায়ে বড় একটা কটকটে লাল রঙের কোট। কোটটির স্কুল নেমে এসছে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। চোখে সোনালি রঙের একটি নিকেলের চশমা। কোটটি নিখল সাব আসবার সময় দিয়েছেন। চশমাটি হাসপাতালে খুজে পাওয়া। চশমায় সব জিনিস কেমন যেন ঘঘালাটে দেখায়। কোটের সঙ্গে চশমা না থাকলে মানায় না বলেই গ্রামে ঢোকবার মুখে আমিন ডাক্তার চোখে চশমা দিয়ে নিয়েছে।
মতি মিয়া নইম মাঝির ঘরে তাস খেলছিল। খবর পেয়ে দৌড়ে এসেছে। এত রাতেও আশেপাশেরদু-এক ঘরের মেয়েছেলেরা এসে জড়ো হয়েছে। নুরুদ্দিনকাঁচা ঘুম ভেঙে অবাক হয়ে দাওয়ায় বসে আছে।
শরিফা ঘরের ভেতরে চৌকির উপর বসে ছিল। মতি মিয়াকে দেখে সে মুখ ফিরিয়ে নিল। যেন কোনো কারণে লজ্জা পাচ্ছে। মতি মিয়া অবাক হয়ে দেখল, শরিফার গোল মুখটা কেমন যেন লম্বাটে লাগছে। চুল অন্যভাবে বাঁধার জন্যই হোক, বা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক–শরিফাকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। মতি মিয়া গভীর হয়ে বলল, শরীলডা বালা?
শরিফা জবাব দিল না।
কি, শরীলডা বালা?
শরিফা থেমে থেমে বলল, পাওড়া কাইট্টা বাদ দিছে।
মতি মিয়া স্তম্ভিত হয়ে গেল। সত্যি সত্যি শরিফার একটা পা নেই।
শরিফা বলল, বাঁচনের আশা আছিল না। কপালে আরো দুঃখ আছে, হেই কারণে বাঁচলাম। তোমার শইলা কেন?
মতি মিয়া চুপ করে রইল। সে তখনো শরিফার একটি পা, যা শাড়ির ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আছে, সে দিকে তাকিয়ে আছে। সেই পাটিতে আবার লাল টুকটুক একটা নতুন স্যাণ্ডেল। শরিফা থেমে থেমে বলল, রহিমা অখনো এই বাড়িত ক্যান? তারে বিদায় দেও নাই ক্যান? যুবতী মাইয়ামানুষ নিয়া এক ঘরে থাক, কাজটা ভালো কর নাই। রহিমারে কাইল সক্কালেই বিদায় দিবা, বুঝছ?
মতি মিয়া জবাব দিল না। শরীফা চিকন সুরে বলল, আর নুরার শইলডা কেমুন খারাপ হইছে। আমি ডাক দিছি, হে আসে নাই। দৌড় দিছে রহিমার দিকে। এই সব বালা লক্ষণ না। রহিমা তার কে?
রহিমা তার পুঁটলি গুটিয়ে মেয়ের হাত ধরে
রহিমা তার পুঁটলি গুটিয়ে মেয়ের হাত ধরে চৌধুরীবাড়ি চলে গেল। তার নিজের বাড়ি-ঘর কিছু নেই। চৌধুরীদের দালানের শেষ মাথায় একটি অন্ধকার কুঠরিতে সে মাঝেমধ্যে এসে থাকে। চৌধুরীরা কিছু বলে না। যত দিন এখানে থাকে, তত দিন যন্ত্রের মতো এ বাড়ির কাজকর্ম করে। যেন এটিই তার বাড়ি-ঘর।
একনাগাড়ে অবশ্যি বেশি দিন থাকতে হয় না। গ্রামের কোনো পোয়াতি মেয়ের বাচ্চা হয়েছে, কাজকর্মের লোক নেই–মহিমাকে খবর দেয়। রহিমা তার ছোট্ট পুঁটলি আর মেয়ের হাত ধরে সে-বাড়িতে গিয়ে ওঠে। রান্নাবান্না করে। শামুক ভেঙে হাঁসকে খাওয়ায়। ছাগল হারিয়ে গেলে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজতে বের হয়। যেন নিতান্তই সে এই ঘরেরই কেউ। নতুন বাচ্চাটি এক দিন শক্তসমর্থ হয়ে ওঠে, রহিমাকে মেয়ের হাত ধরে আবার ফিরে আসতে হয় চৌধুরীবাড়ির অন্ধকার কোঠায়। প্রথম প্রথম খারাপ লাগত, এখন আর লাগে না।
দীর্ঘদিন পর আজ এই প্রথম রহিমার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। মতি মিয়ার ঘর-বাড়ি কোনট-এক বিচিত্র কারণে তার কাছে আপন মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল এখানে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে চমৎকার হত। তার কপালটা এরকম কেন?
নতুন বৌ হয়ে যখন আসে, অনুফার বাবা তখন কামলা মানুষ। বৌ তোলার জায়গা নেই। মানুষটা নতুন বৌকে চৌধুরীদের বারান্দায় বসিয়ে রেখে উধাও হয়ে গেছে ঘর-দুয়ারের ব্যবস্থা করতে। চৌধুরী সাহেব মহা বিরক্ত, নতুন বৌয়ের সামনেই ধমকাচ্ছেন, অগ্ৰায়ণ মাসে এমন কাম-কাজের সময় কেউ কি বিয়াসাদি করে? তোর মতো আহাম্মক খোদার আলমে নাই রে মনু।
লেকটা দাঁত বের করে হাসে। চৌধুরী সাহেব প্ৰচণ্ড ধমক দেন। হারামজাদা হাসিস না। আমার পুবের একটা ঘর খালি আছে, বৌরে সেইখানে নিয়া তোল।
চৌধুরী সাব, নিজের একটা ঘরে নিয়া তুলনের ইচ্ছা। বাঁশটাশ যদি দেন তো একটা ঘর বানাই।
চৌধুরী সাহেব চোখ কপালে তুলে বললেন, ঘর তুলবি, জায়গা-জমি কই? ঘর তুলবি কিসের উপর?
আমার বসতবাড়ির লাগি একটুখানি জায়গাও যদি দেন, ধীরে ধীরে দাম শোধ করবাম।
বলতে বলতে লোকটা হাসে। যেন খুব একটা মজার কথা বলছে। চৌধুরী সাহেব অবশ্যি তাকে জায়গা দেন। মসজিদের কাছের এক টুকরো পতিত জমি। লোকটা ঘরামির কাজে খুব ওস্তাদ ছিল। দেখতে দেখতে বাঁশ কেটে চমৎকার একটা ঘর তুলে ফেলল। নতুন-কাটা কাঁচা বাঁশের গন্ধে রহিমার রাতে ঘুম আসে না। পেটের মধ্যে পাক দিয়ে ওঠে। লোকটির অবশ্যি ফুর্তির সীমা নেই। দুপুর রাতে কুপি জ্বালিয়ে বাঁশের কঞ্চি কাটছে। ঘরের চার দিকে বেড়া দেবে। বিশ্রাম এক জিনিস সে জানত না।