ছেলেকে দাঁড় করিয়ে মতি মিয়া চলে যায় কানা নিবারণের সামনে। দেখা না করে যাওয়াটা ঠিক না।
নিবারণ ভাই, শইলডা বালা?
কানা নিবারণ কথা বলে না, ভ্রূ কুঁচকে তাকায়।
চিনছেন আমারে? আমি মতি। সোহাগীর মতি মিয়া।
কানা নিবারণ ঘঘালাটে চোখে তাকায়, উত্তর দেয় না।
আসলাম মিয়ার গাওনা হনতে আইছেন নি নিবারণ ভাই? কানা নিবারণ সে কথারও জবাব দেয় না।
বাড়ি ফিরেও নুরুদ্দিন কোনো রকম ঝামেলা করে না। নিজের মনেই থাকে। মতি মিয়া বারবার জিজ্ঞেস করে, মার লাগি পেট পুড়ে?
নাহ।
মুখ শুকনা ক্যান? নিচ্ছ পেট পুড়ে?
নাহ।
মতি মিয়ার নিজেরই খারাপ লাগে। কিছুতেই মন বসে না। নইম মাঝির বাড়ি সন্ধ্যার পর গান-বাজনার আয়োজন হয়। মতি মিয়া বোজ যায়, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। সেখানেও শুধুই যাই-যাই করে।
সন্ধ্যা কালে বাড়িত গিয়া করবাটা কী মতি ভাই?
পুলা একলা আছে।
হে তো ঘুমইতাছে। বও দেহি, হুক্কাডাত একটা টান দিয়া হারমুনিডা ধর।
বাড়ি ফিরে তার ভালো লাগে না। কেমন উদাস লাগে। রাতের খাওয়া শেষ হলে এক-আধ দিন রহিমার সাথে খানিক গল্পগুজব করে। রহিমা লম্বা ঘোমটা টেনে বারান্দায় বসে। কথা বলার সময় মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখে। মতি মিয়া তার গ্রাম সম্পর্কে ভাসুর। তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। রহিমার সঙ্গে কথা বলতে মতি মিয়ার খারাপ লাগে না।
নিখল সাব কেমন ডাক্ত মতি ভাই?
জব্বর ডাক্তর।
পরিষ্কার বাংলা কথা কয়?
তা কয়। গেরাইম্যা কথাও কইতে পারে?
না। বুঝতে পারে।
দুনিয়াডাত কত কিসিমের জিনিসই না আছে মতি ভাই।
কথা ঠিক। খুব খাড়ি কথা।
নিখল সাব ডাক্তরে দেখনের বড় শখ লাগে মতি ভাই।
তা এক দিন যামুনে নিয়া। দুই দিনের মামলা।
দেখতে দেখতে মাস পার হয়ে যায়, ঘোর বর্ষা নামে। শরিফাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। এক সপ্তাহের কথা বলে চৌধুরীদের একটা নৌকা নেওয়া হয়েছিল। চৌধুরীবাড়ির কামলা এসে রোজ হম্বিতম্বি করে।
বৈশাখ মাসের শেষাশেষি। কাজকর্ম নেই। সোহাগীতে বোরা ধান ছাড়া কিছুই হয় না। ভাটি অঞ্চলগুলিতে তাই অগ্রহায়ণ না আসা পর্যন্ত অলস মন্থর দিন কাটে। মতি মিয়া উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরাঘুরি করে। শরিফাদের ফিরতে এতটা দেরি হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পায় না। বড়োই মন খারাপ লাগে তার। পাড়াপড়শিও খোঁজখবর করে।
বাচ্চা বিয়াইতে বাপের বাড়িতে গেলেও তো এক মাসের মধ্যে ফিরে, কিন্তু ইদিকে যে মাসের উপর হইল। খোঁজখবর কর মতি। গাছের মত থাইক না।
নইম মাঝি এক দিন ঠাট্টার ছলে অন্য রকম একটা ইঙ্গিত করে, মতি ভাই, আমি চিন্তা করছি আমিন ডাক্তারের সাথে নটখট কইরা দেশান্তরী হইল কিনা। পালের নৌকা তো সাথেই আছে, হা হা হা।
গা রিরি করে মতি মিয়ার। নেহায়েত বন্ধুমানুষ বলে চুপ করে থাকে। নইম মাঝি বলে, রাগ করলা নাকি, ও মতি ভাই। ঠাট্টা-মজাক বুঝ না তুমি?
না, রাগ-ফাগ করি নাই।
আর বিবেচনা কইরা দেখ, আমিন ডাক্তরের সাথে ভাবীবের খাতির-প্রণয় একটু বেশিই ছিল। হা হা হা।
হাইস না নইম, এইসব হাসি-মজাকের কথা না।
এই তো রাগ হইল। ভাবীর লগে রঙ-তামশা না করলে কার লগে মু? হাসিঠাট্টা বুঝতে পারার মত বুদ্ধিশুদ্ধি মতি মিয়ার আছে। কিন্তু শরিফা এবং আমিন ডাক্তারকে নিয়ে এই জাতীয় ঠাট্টা সে সহ্য করতে পারে না। কারণ, ব্যাপারটা পুরোপুরি ঠাট্টা নয়। আমিন ডাক্তার কাজে-অকাজে তার বাড়ি এস গলা উচিয়ে ডাকবে, দোস্তাইন, ও দোস্তাইন। চায়ের পাতা নিয়া আসলাম। জর পাতা। একটু চা খাওন দরকার। ঘরে গুড় আছে?
মতি মিয়ার অসংখ্য বার ইচ্ছা হয়েছে আমিন ডাক্তারকে ডেকে বলে দেয়, যাতে সময়ে-অসময়ে এইভাবে না আসে। কিন্তু কোনো দিন বলা হয় নি। এটা অত্যন্ত ঘোট কথা। আমিন ডাক্তারের মতো বন্ধুমানুষকে এমন একটা ছোট কথা বলা যায় না।
শরিফাদের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে মতি মিয়া অনেক কিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে। গান-বাজনা এখন ভালো লাগে না। নিখল সাব ডাক্তারের হাসপাতালে চলে গেলে হয়। মেলা খরচান্ত ব্যাপার। আবার একটু লজ্জালজ্জাও করে। নুরুদ্দিনকে আড়ালে এক বার জিজ্ঞেস করে, ও নুরা–মারে আনতে যাইবি?
নাহ।
না কি ব্যাটা! মার লাগি পেট পুড়ে না?
নাহ।
কস কী হারামজাদা! মায়া-মুত কিছুই দেহি তর মইধ্যে নাই।
নুরুদ্দিন মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে দেখে মনেই হয় না, মায়ের দীর্ঘ অনুপস্থিতি তাকে কিছুমাত্ৰ বিচলিত করেছে।
নুরুদ্দিন রহিমার মেয়ে অনুফার সাথে গম্ভীর মুখে সারা দিন খেলাধূলা করে। দুপুরের দিকে প্রায়ই দেখা যায় নুরুদ্দিন গাঙের পাড়ের একটি জলপাই গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। গাছের নিচে পা ছড়িয়ে বসে আছে অনুফা। দুই জনেই নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলছে। মতি মিয়া বেশ কয়েক বার লক্ষ করেছে ব্যাপারটি। এক দিন নুরুদ্দিনকে ডেকে ধমকেও দিল, গাছের মধ্যে বইয়া থাক, বিষয় কী?
নুরুদিন নিরুত্তর।
দুপুরবেলা সময় খারাপ। জ্বীন-ভূতের সময়, হেই সময় গাছে বইয়া থাকনের দরকার কী?
নুরুদ্দিন চোখ পিটপিট করে। কথা বলে না।
খবরদার, আর যাইস না।
আইচ্ছা।
তবু নুরুদ্দিন যায়জলপাই গাছের নিচু ডালটিতে পা ঝুলিয়ে বসে আপন মনে কথা বলে। গাছের গুড়িতে বসে থাকে অনুফা। ক্ষণে ক্ষণে ফিক্ফিক্ করে সে। মতি মিয়া ঠিক করে ফেলে নুরুদ্দিনের জন্যে একটা তাবিজটাবিজের ব্যবস্থা করা দরকার। লক্ষণ ভালো নয়। রহিমার সঙ্গেও এই বিষয়ে সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়। মতি মিয়া আড়াল থেকে শুনেছে, রহিমার সঙ্গে সে হড়বড় করে অনবরত কথা বলে। রাতের বেলা কাঁথা-বালিশ নিয়ে রহিমার সঙ্গে ঘুমাতে যায়। এতটা বাড়াবাড়ি মতি মিয়ার ভালো লাগে না।