আমিন ডাক্তার চুপ করে থাকল। মতি মিয়া বলল, খাওয়া-খাইদ্য শেষ কইরা চল বাড়িত যাই।
মতি ভাই, চল মিশনারি হাসপাতালে লইয়া যাই। বেশি দূর না, একটা মুটে হাওর পরে সোনাদিয়া হাওর।
আমিন ডাক্তারের কথা শেষ হবার আগেই মতি মিয়া ঝাঁঝিয়ে ওঠে, এই সব খিরিস্তানির মধ্যে আমি নাই। এই সব কথা মুখে আইন্য না, বুঝলা?
আমিন ডাক্তার চুপ করে যায়। শরিফারও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। জারুল গাছের ছায়ায় নৌকা বেঁধে ভরপেট চিড়া খেয়ে মতি মিয়া ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুম ভাঙে সন্ধ্যার পর। নৌকা তখন সোনাদিয়ার হাওরে পড়েছে। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। পাল খাটান হয়েছে। আমিন ডাক্তার হাল ধরে বসে আছে। ভাবখানা এরকম, যেন কিছুই জানে না।
মতি ভাই, বাতাসের এই ধরনের জোর থাকলে এক পহরেই মিশনারি হাসপাতালে পৌঁছান যাইবে।
মতি মিয়া চুপ করে থাকে।
তামুক খাইবা নাকি, কি ও মতি ভাই?
নাহ্।
মিশনারি হাসপাতালে এক বার নিয়া ফেলতে পারলে বুঝলা আর চিন্তা নাই। হেইখানে নিখল সাব ডাক্তার খুব এলেমদার লোক।
মতি মিয়া চুপ করে থাকে। আড়চোখে দেখে, আজরফ কাল রাতের পরিশ্রমে কাহিত হয়ে মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে। শরিফার মুখের কাছে ভনভন করে মাছি উড়ছে একটা। মরে গেছে নাকি? মরলেই কি আর বেঁচে থাকলেই কি? হাওরের দিগন্তবিস্তৃত কালো পানির দিকে তাকিয়ে মনটা উদাস হয়ে যায় তার। জগৎসংসার তুচ্ছ বোধ হয়। সে চাপা স্বরে গুনগুন করে–,
লোকে আমায় মন্দ বলে রে
মন্দ বলে মন্দ বলে মন্দ বলে রে
আমি কোথায় যাব কি করিব
দুঃখের কথা কাহারে করে।
মন্দ বলে মন্দ বলে মন্দ বলে রে।
আমিন ডাক্তার মৃদু স্বরে বলে, তুমি কিন্তু বড়ো ছাতক, মতি ভাই।
গয়নার নৌকায়
মতি মিয়া পাঁচ দিন পর গয়নার নৌকায় ফিরে এল। সঙ্গে নুরুদ্দিন। নিখল সাব ডাক্তার (রিচার্ড এ্যালেন নিকলসন) বলেছেন সারতে সময় নেবে। অবস্থা ভালো নয়, কাটাকুটি করতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে মাসখানেক লেগে যাওয়া বিচিত্র নয়।
আমিন ডাক্তারের নাকি তেমন কাজকর্ম নেই। সে নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে, সব ঠিকঠাক করিয়ে নিয়ে আসবে। মতি মিয়া অবাক হয়ে বলেছে, এক মাস যদি থাকন লাগে, তুমি খাইবা কী?
হইব একটা ব্যবস্থা। রুগী ফালাইয়া তো যাওন যায় না।
ব্যবস্থা যে কী হবে, মতি মিয়ার মাথায় আসে না। আমিন ডাক্তারের কাছে। আছে সর্বমোট সাড়ে ন টাকা। কিন্তু আমিন ডাক্তারকে মোটই বিচলিত মনে হয় না। আজরফকে অবশ্যি নিখল সাব বাসায় কাজ দিয়েছেন। নদী থেকে সে গোসলের পানি তুলে আনে, বিকালে হাসপাতালের মেঝে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হয়। যত ঘৰাঘষিই করা হোক, সাহেবের পছন্দ হয় না। মাথা নেড়ে বলেন, আরো ভালো করো। জোরে ব্রাশ করে।
খাওয়াদাওয়া সাহেবের এখানেই হয়। সে খাওয়াও রাজ-রাজড়ার খাওয়া। সকালবেলা পাউরুটি, চিনি, একটা কলা আর এক কাপ দুধ। সন্ধ্যাবেলা বই-খাতা নিয়ে বসতে হয়। কালো মোটামত এক জন মহিলা অনেককে বর্ণ-পরিচয় শেখান। একটি ব্লকবোর্ড প্ৰকাণ্ড একটা অ লিখে সুরেলা স্বরে বলেন, বল অ। সবাই সমস্বরে বলে, অ। বল আ . … .আ।
আজরফের খুব মজা লাগে। পড়া শেষ হবার পর হয় প্রার্থনা। ভদ্রমহিলা অত্যন্ত করুণ সুরে টেনে টেনে বলেন,
হে পরম করুণাময় ইশর,
তুমি তোমার মঙ্গলময় করুণার হস্ত প্রসারিত কর।
…. … … … …
প্রার্থনার জায়গায় এলেই আজরফের ভয়ভয় করে। কে জানে এরা হয়তো খিরিচান করে ফেলছে। আমিন ডাক্তার অবশ্যি বলেছে, ভয়ের কিছু নেই। খিরিানী প্রার্থনার ফাঁকে ফাঁকে মনে মনে কলেমা তৈয়ব পড়লেই সব দোষ কেটে যাবে। আমিন ডাক্তারের মতো জ্ঞানী লোককে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আজরফের আর ভয়টয় করে না। ভয় করে মতি মিয়ার। কোন কারণ ছাড়াই ভয় করে। নৌকা ছেড়ে নড়তে চায় না। আমিন ডাক্তারের ঠেলাঠেলিতে শরিফাকে দেখতে গিয়ে এক কাণ্ড। হাসপাতালের বারান্দায় মুখ ভর্তি করে বমি করে। আমিন ডাক্তার শঙ্কিত হয়ে বলে, হইল কি তোমার মতি ভাই?
বদ গন্ধ মাথার মধ্যে পাক দেয়।
তোমারে নিয়া মুশকিল। ঐটা তো ফিাইলের গন্ধ।
কিসের গন্ধ?
ফিনাইল। এক কিসিমের সাবান। খুব ভালো জিনিস।
ভালো জিনিস মাথায় থাকুক। মতি মিয়া বাড়ি ফিরে বাঁচে, নুরুদ্দিন বাপের সঙ্গে ফিরে যেতে কোনো আপত্তি করে না। মতি মিয়া বারবার জিজ্ঞেস করে, মার লাগি মন কান্দে নি নুরু?
নাহ্।
দুই দিন পরেই দেখবি আইয়া পড়ছে।
আইচ্ছা।
খুব বেশি হইলে এক হস্তা। এর বেশি না।
আইচ্ছা।
যাত্রা দেখতে চাস? মোহনগঞ্জে যাত্ৰা আইছে। বিবেকের পাঠ করে আসলাম মিয়া। ছয়টা সোনার মেডেল। দেখবি?
নাহ্।
না বললেও মতি মিয়া এক রাত মোহনগঞ্জে থেকে যায়। এত কাছে এসে আসলাম মিয়ার বিবেকের গান না শোনা পাশের সামিল। নিতি দিন তো আর এমন সুযোেগ হয় না। মোহনগঞ্জ বাজারে দেখা হয়ে যায় কানা নিবারণের সাথে। সেও খুব সম্ভব আসলামের গান শুনতে এসেছে। সে একটা বড়ো কাপড়ের দোকানের সামনে বসে ছিল। তার মুখ দিয়ে ভকভক করে দেশী মদের গন্ধ বেরুচ্ছে।
ও নুরা, দেখছ? হই দেখ কানা নিবারণ।
কোন জন?
কালামতো মোটা। লম্বা বাবড়ি।
চউখ তো দুইটাই আছে, ইনারে কানা নিবারণ ডাকে ক্যান?
ছেলের কথায় মতি মিয়া বড়ই খুশি হয়। ছেলে চুপচাপ থাকলে কী হবে, বুদ্ধিশুদ্ধি ঠিকই আছে। মতি মিয়া হাসিমুখে বলে, মাইনষের খিয়াল! মাইনষের খিয়ালের কি ঠিক-ঠিকানা আছে?