শরিফার চলচ্ছক্তি নেই। বিছানায় রাত-দিন শুয়ে থাকতে হয়। অসম্ভব। বুড়িয়ে গেছে। কথাবার্তাও অসংলগ্ন।
আমিন ডাক্তার যখন বলল, দোস্তাইন, শরীলডা বালা? শরীফা শুন্যদৃষ্টিতে তাকাল।
আমি আমিন, আমিন ডাক্তার।
শরিফা চিনতে পারল না। খানিকক্ষণ চুপ থেকে চাপা গলায় বলল, এরা আমারে ভাত দেয় না। আমারে না খাওয়াইয়া মারণের ইচ্ছা। আজরফ হারামজাদারে সালিসি ডাইক্যা জুতা পিটা করণ দরকার। আপনে আজরফ হারামজাদারে একটা ধমক দিয়া যান।
দোস্তাইন, আপনে আমারে চিনতে পারছেন না?
আজরফ হারামজাদা ইন্দুর মারা বিষ কিন্যা রাখছে। পানির সাথে মিশাইয়া খাওয়াইতে চায়।
আজরফ মনে হল আমিন ডাক্তারকে হঠাৎ উদয় হতে দেখে ঠিক সহজ হতে পারছে না। কোথায় উঠেছে, কোথায় খাচ্ছে, কিছুই জিজ্ঞেস করল না। নিজের বাড়িতে এসে উঠবার কথাও বলল না। থেমে থেমে বলল, সোহাগীতে থাকবেন। নি ডাক্তার চাচা?
আর যাইয়াম কই ক?
ডাক্তারী কইরা তো আর কামাইতে পারতেন না। সরকারী ডাক্তার আছে এখন। বালা ডাক্তার।
ওখন আর কাজ-কামের বয়স নাই আজরফ। শইলডা নষ্ট হইয়া গেছে।
নুরুদ্দিন লম্বা-চওড়া জোয়ান হয়েছে। বাপের মতো লম্বা চুল ঘাড় পর্যন্ত এসেছে। আমিন ডাক্তার বলল, তুইও গান গাস নাকি নুরা?
জ্বী-না চাচা।
জংলা ভিটার ঘাটে যাস?
না চাচাজী, অখন আর যাই না।
আমারে লইয়া এক দিন জংলা ভিটার ঘাটে যাইস।
ক্যান চাচা?
দেখনের ইচ্ছা হইছে।
এই দীর্ঘ সময়েও জংলা ভিটার ঘাটের কোন পরিবর্তন হয় নি। জায়গাটির বয়স বাড়ে নি। আমিন ডাক্তার অবাক হয়ে দেখল, সেই ডেফল গাছটি এখনো আছে। নুরুদ্দিন লগি দিয়ে খুন্দা ঠেলছিল। সে হালকা গলায় বলল, জংলা ভিটায় মাইট আছে চাচা।
কে কইছে?
আমার মনে অয়।
খুন্দা এগুচ্ছে খুব ধীর গতিতে। ডেফল গাছের কাছের বাঁকটি পেরুতেই আমিন ডাক্তার বলল, এইখানে তুই একটা মেয়েমানুষ দেখছিলি। পানির মইধ্যে ভাসতে ছিল। হাতের মধ্যে লাল চুড়ি। তোর মনে আছে?
নুরুদ্দিন থেমে থেমে বলল, আছে চাচা। স্বপ্ন দেখছিলাম কিংবা চউখের ধান্ধা।
নুরুদ্দিনের অস্বস্তি লাগে। ফ্যাকাশেভাবে হাসে।
তুই ঠিকই দেখছিলি। স্বল্প-টপু না। আমি এই জিনিসটা নিয়া অনেক চিন্তা করছি। জেলখানাতে চিন্তার খুব সুবিধা আছিল রে নুরা।
নুরুদ্দিন চুপ করে রইল। আমিন ডাক্তার একটা সিগারেট ধরিয়ে কাশতে লাগল। কাশি থামিয়ে শান্ত স্বরে বলল, একটা কথা মন দিয়া শুন। মেয়েটার হাতভর্তি আছিল লাল চুড়ি। হাতভর্তি চুড়ি কোন সময় থাকে জানস নুরা?
নাহ্।
যখন নতুন চুড়ি কিনে। যত দিন যায়, তত চুড়ি ভাঙ্গে, আর কমে। কিছু বুঝতাছস?
নাহ্।
সোহাগীতে সেই বৎসর চুড়িওয়ালী আছিল শ্রাবণ মাসে। সব মেয়েরা চুড়ি কিনছে, তোর মাও কিছিল।
নূরুদ্দিন ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনে কইতেছেন মেয়ে সোহাগীর?
হ্যাঁ।
কিন্তু সোহাগীর কোনো মেয়ে তো মরে নাই চাচাজী।
মরে নাই কথাটা ঠিক না নুরা। বানের সময় সরকারবাড়ির একটা বউ নিখোঁজ হইছিল। কত খোঁজাখুঁজি করল, তোর মনে নাই?
আছে।
আমিন ডাক্তার চাপা স্বরে বলল, বানটা হইছিল কিন্তু জংলা ভিটার ঘটনার। তিন দিন পরে।
নুরুদ্দিন লগি হাতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বহু কাল আগে থইরকল গাছ থেকে অসংখ্য কাক কাকা-কে উড়ে গিয়েছিল। আজও হঠাৎ চারদিক থেকে কাক ডাকতে লাগল। নুরুদ্দিন হাত থেকে লগি ফেলে দিল। আমিন ডাক্তার শান্ত স্বরে বলল, ভয় পাইছস নুরা?
পাইছি।
ভয়ের কিছু নাই। চল ফিরত যাই।
ফিরবার পথে আমিন ডাক্তার একটি কথাও বলল না। দক্ষিণ কান্দায় নৌকা বেঁধে দুজনে উপরে উঠে এল। আমিন ডাক্তার মৃদু স্বরে বলল, একটা খুব বড় অন্যায় হইছে সরকারবাড়িত। একটা মেয়েরে খুন কইরা ফালাইয়া রাখছিল জংলা ভিটাত। বুঝতামস তুই নুরা?
চাচা বুঝতাছি।
আমি ওখন কি করবাম জানস?
নাহ।
সরকারবাড়ির সামনের ক্ষেতটাত গিয়া বসবাম। বলবাম, আপনেরা একটা বড়ো অন্যায় করছেন। তার বিচার চাই।
আমিন ডাক্তার হেসে উঠল।
এক অপরাহ্নে আমিন ডাক্তার তার ধূলিধূসরিত লাল কোট গায়ে দিয়ে সরকারবাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। মানুষটি ছোটখাট, কিন্তু পড়ন্ত সূর্যের আলোয় তার দীর্ঘ ছায়া পড়ল। সন্ধ্যা এগিয়ে আসছে বলেই হয়ত সরকারবাড়ির সামনের প্রাচীন জামগাছ থেকে অসংখ্য কাক কাকা করে ডাকতে লাগল।
——–
আঞ্চলিক শব্দের অর্থ
মাইট – স্বর্ণমুদ্ৰাপূৰ্ণ কলসি। সাধারণত মাটির নিচে পোঁতা থাকে এবং আলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন (?) হয়ে থাকে। এরা নিজেরাই চলাচল করতে পারে।
খুন্দা – ঘাস-কাটা হোট নৌকা।
দোস্তাইন – বন্ধুর স্ত্রীকে ডাকার জন্যে ব্যবহৃত সম্মানসূচক সম্বোধন।
বাঘাই সিন্নি – নবান্ন জাতীয় উৎসব।
বারাবান্দানী – যারা ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।
লারবড়শি – বোয়াল মাছ মারবার জন্যে ব্যবহৃত বড়শি। জ্যান্ত ব্যাঙ বা টাকি মাছের টোপ দিয়ে এই সব বড়শি সারা রাত পেতে রাখা হয়।
মা-খলা – মাছ শুকানর জন্যে ব্যবহৃত উঁচু জায়গা।
ফিরাইল – শিলাবৃষ্টির হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্যে এক শ্রেণীর বিশেষ মত্ৰশক্তিসম্পন্ন (?) ফকির।
জিরাতী – ভিনদেশী চাষী, যারা চাষ শেষ হলে ধান নিয়ে নিজ দেশে চলে যায়।
কান্দা – বাঁধ জাতীয় উঁচু জায়গা (প্রাকৃতিক)।
বন্দ – ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ। ভাটি অঞ্চলের বনগুলি বর্ষায় হাওড়ে পরিণত হয়।
পাইল করা – মাছ মারা বন্ধ রাখা। সাধারণত জলমহালগুলি দু-তিন বৎসর পাইল করার পর মাছ মারা হয়।