অষুধের দাম বাবদ এক টাকা ছাড়াও আর পাঁচটা টাকা তারা রাখল আমিন ডাক্তারের সামনে। আমিন ডাক্তার অবাক।
এক টাকা ভিজিট আমার।
ডাক্তার সাব, রুগীর নিজের টাকা। সে আপনেরে দিতে চায়। কইল, সকালে আরেক বার আইস্যা দেখন লাগব।
না কইলেও আসবাম। রুগীর একটা বিহিত না হইলে কি আর ডাক্তারের ছুটি আছে? ডাক্তারী সোজা জিনিস?
হৃষ্টচিত্তে বাড়ির পথ ধরল আমিন। পিছে পিছে এক জন এল হারিকেন নিয়ে। যার যা কাজ সেটা না করলে কি আর ভালো লাগে? না, ডাক্তারীটা আবার শুরু করতে হয়। অষুধপত্র কেনার জন্যে মোহনগঞ্জ যেতে হবে এবার। নিখল সাবকে একটা চিঠি দিলে কেমন হয়? ডাক্তারের সাথে ডাক্তারের যোগ তো থাকাই লাগে। অনুফার একটা খোঁজও নেওয়া দরকার। কেমন আছে মেয়েটা কে জানে?
আমিন ডাক্তারের বাড়ির উঠোনে গুটিটি মেরে কে যেন বসে আছে। জায়গাটা ঘুঘুটে অন্ধকার।
কে এইখানে?
আমিন চাচা, আমি।
তুই অত রাইতে কী করস?
নুরুদ্দিন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
কান্দস ক্যান? কী হইছে?
আমার মাছটা রাইখ্যা দিছে।
কী রাইখ্যা দিছে?
মাছ।
আমিন ডাক্তার কিছুই বুঝতে পারল না। হারিকেনের আলোয় দেখল, নুরুর সমস্ত গায়ে কালসিটে পড়েছে। ঠোঁট কেটে রক্ত কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে। ডান গাল ডালিমের মতো লাল হয়ে উঠেছে।
এই নুরা, কী হইছে? আমার মাছটা রাইখ্যা দিছে।
আয়, ভিতরে আইয়াক দেহি কী হইছে। কান্দিস না।
ঘটনাটি এ রকম। নুরুদ্দিন তার রুই মাছ নিয়ে দক্ষিণ কান্দায় উঠতেই নিজাম সরকার তাকে দেখতে পান। নিজাম সরকারের ধারণা হয়, মাছটা গতরাত্রে মাছখোলা থেকে চুরি করা। এত বড় একটা মাছ (তাও রুই মাছ) লার বড়শিতে ধরা পড়েছে, এটি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার উপর নুরুদ্দিন সারাক্ষণই জলমহালের আশেপাশে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করে।
নিজাম সরকার নুরুদ্দিনকে ধরে নিয়ে যান মাছখোলায়। মাছ চুরিতে কারা কারা আছে তা জানবার জন্যে মাত্রার বাইরে মারধোর করা হয়। মারের জন্যে নুরুদ্দিনের কিছু যায় আসে না। কিন্তু মাছটি ফেরত পাবার আশাতেই সে বিকাল থেকে আমিন ডাক্তারের জন্যে অপেক্ষা করছে। আমিন ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বলল, যা, বাড়িত যা, আমি সরকারবাড়িত যাইতাছি।
মাছটা তারা দিব আমিন চাচা?
নিশ্চয়। না দিয়া উপায় আছে? কান্দিস না। বাড়িত যা।
এইখানে বইয়া থাকি চাচা, আপনে মাছটা লইয়া আইয়েন।
নিজাম সরকার আমিন ডাক্তারের কথা শুনে বিরক্ত হলেন। এ কি ঝামেলা! তামাক টানা বন্ধ রেখে গম্ভীর মুখে বললেন, চোরের যে সাক্ষী, হেও চোর– এইডা জান ডাক্তার?
সরকার সাব, নুরু চুরি করে নাই।
চুরি করছে না, তুমি নিজে দেখছ?
আমিন ডাক্তার থেমে থেমে বলল, সরকার সাব, চুরি যে নুরু করছে, হেইডাও তো আপনে দেখেন নাই।
নিজাম সরকার স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কড়া গলায় বললেন, বাড়িত যাও ডাক্তার।
সরকার সাব একটা বড়ো অন্যায় হইছে। অন্যায়কার বিহিত হওন দরকার।
তুমি বড়া ঝামেলা করতাছ। যাও, বাড়িত গিয়া ঘুমাও। সকালে আইবা, তোমার সাথে কথা আছে।
আমিন ডাক্তার থেমে থেমে বলল, অন্যায়ের বিহিত না হওন পর্যন্ত আমি যাইতাম না।
কী করবা তুমি?
আপনের বাড়ির সামনের ক্ষেতটার মইধ্যে বইয়া থাকতাম।
যাও, থাক গিয়া।
নিজাম সরকার আমিন ডাক্তারের স্পৰ্ধা দেখে অবাক হলেন। ছোটলোকেরা বড়ো বেশি আঙ্কারা পেয়ে যাচ্ছে। শক্ত হাতে এই সব বন্ধ করতে হবে। এশার নামাজের পর উঠোনে এসে দেখেন আমিন ডাক্তার সত্যি সত্যি বাড়ির সামনের ক্ষেতটার মাঝখানে উবু হয়ে বসে আছে। চৌধুরীদের পাগলা ছেলেটাও আছে সেখানে; চেঁচাচ্ছে, চোরের গুষ্টি বিনাশ করণ দরকার। চোরের গুটি বিনাশ করণ খুব বেশি দরকার। চৌধুরীবাড়ির কামলারা এসে পাগলাটাকে ধরে নিয়ে গেল।
নইম মাঝির বাড়িতে অনেক রাত পর্যন্ত টোয়েন্টি-নাইন খেলা হয়। নইম মাঝি মাঝরাত্রে খেলা ফেলে দেখতে গেল, আমিন ডাক্তারের ব্যাপারটা কত দূর সত্যি। হ্যাঁ, আমিন ডাক্তার বসে আছে ঠিকই। তার গায়ে লাল রঙের কোট। কার্তিক মাসের ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে বলেই মাথার উপর ছাতি মেলা হয়েছে।
সত্যি সত্যি বাড়িত যাইতা না ডাক্তার ভাই?
নাহ।
জার পড়ছে খুব। বিড়ি খাইবা? চান বিড়ি আছে।
দেও দেখি।
বিড়ি ধরিয়ে নইম মাঝি শান্ত স্বরে বলল, ডাক্তার ভাই, বাড়িত গিয়া ঘুমাও। শীতের মইধ্যে বইয়া থাইক্যা লাভটা কী, কও?
আমিন ডাক্তার কিছু বলল না।
হঠাৎ বিড়ির লালাভ আগুনে নইম মাঝি লক্ষ করল, আমিন ডাক্তার কাঁদছে। সে বড়ই অবাক হল। নইম মাঝি সেই রাত্রে আর বাড়ি ফিরল না। নয়া কৈবর্তপাড়ায় প্রতি রাতেই ঢোল বাজিয়ে গান-বাজনা হয়। আজ আর হল না।
নিজাম সরকার কল্পনাও করেন নি
নিজাম সরকার কল্পনাও করেন নি ব্যাপারটা এত দূর গড়াবে। একটা আধাপাগলা লোক বাড়ির সামনে ছাতা মাথায় দিয়ে বসে থাকলে, কার কী যায় আসে?
কিন্তু নিজাম সরকার ফজরের নামাজ শেষ করে বারান্দায় এসে দেখেন, আমবাগানে দশ-বার জন লোক জটলা পাকাচ্ছে। আমিন ডাক্তারের গা ঘেঁষে বসে আছে নইম মাঝি। নইম মাঝি নিজাম সরকারকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্লামালিকুম সরকার সাব।
নিজাম সরকার গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। নামাজের পর তিনি উঠোনে বসে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কোরআন শরিফ পড়েন। আজ পড়তে পারলেন না। হনহন। করে এগিয়ে গেলেন আমিন ডাক্তারের দিকে।