শেষ দিন যখন খেতে গেল তখন খুব ভালো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। মাঝখানে চৌধুরী সাহেব এসে খোঁজ নিয়ে গেলেন।
শেষ কয়টা দিন তোমার কষ্ট হইল ডাক্তার, সময়টা আমার খারাপ পড়ছে, কী আর করবা কওঁ।
না-না চৌধুরী সাব, কী কন আপনি?
কোনো দিন চিন্তাও করছি না, আমার বাড়ির অতিথ চাইর পদের নিচে খানা খাইব।
চৌধুরী সাহেব কিছুক্ষণ থেকেই চলে গেলেন। খাওয়াদাওয়ার শেষে বৌটি। যথারীতি মিষ্টি গলায় বলল, পেট ভরছে ডাক্তার চাচা?
আমিন ডাক্তারের চোখে পানি এসে গেল। সে ধরাগলায় বলল, খুব খাইছি, মা।
বসেন, পান আনতে গেছে।
আমিন ডাক্তার থেমে থেমে বলল, অনেক ভদ্রলোক দেখছি মা এই জীবনে, কিন্তু চৌধুরীর মতো ভদ্রলোক দেখলাম না।
বৌটি অনেকক্ষণ কোন কথা বলল না। আমিন ডাক্তার যখন চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে, শান্ত গলায় বলল, ডাক্তার চাচা, আমার বিয়ার সময় এরা কিন্তু কয় নাই–ছেলেটা পাগল। ছয় বৎসর বিয়া হইছে, কিন্তু আমারে বাপের বাড়িত যাইতে দেয় না। আমার বাপ-চাচা গরিব মানুষ, তারা কী করব কন?
আমিন ডাক্তার স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। বৌটি মনে হল কাঁদছে। আমিন ডাক্তার থেমে থেমে বলল, মা আমি খাস মনে দোওয়া করছি, ছেলেটা বালা হইয়া যাইব। মাথার দোষ থাকত না। তুমি দেখবা, নিজেই দেখবা।
ঘর থেকে বেরুবার পরপরই পাগল ছেলেটা চেঁচাতে লাগল, এই শালা আমিন চোরা, তরে আইজ খুন কইরা ফাঁসি যাইয়াম। শালা তর এক দিন কি আমার এক দিন।
আমিন ডাক্তার জলমহালে ফিরে এসে দেখে তার ঘরে আজরফ বসে আছে।
কী রে আজরফ–কোনো খবর আছে?
জ্বিনা চাচা। বাজান আবার গেছে গিয়া।
কস কী? কই গেছে?
জানি না।
আজরফ চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই আমিন ডাক্তার দেখল, আজরফের চোখ ভেজা।
বিষয় কি আজরফ, কী হইছে?
জমি কিনার লাগিন যে টেকাপয়সা আছিল, বাজান সব লইয়া গেছে। পাতিলের মইধ্যে আছিল।
কান্দিস না, আজরফ। বেড়া মাইনষের কান্দন ঠিক না, উখ মোছ।
আজরফ শার্টের হাতায় চোখ মুছল।
নুরুদ্দিনের লার বড়শি
রুদ্দিনের লার বড়শিতে প্রকাণ্ড একটি রুই মাছ ধরা পড়েছে। লার বড়শিগুলিতে বোয়াল মাছ ছাড়া অন্য কিছু ধরা পড়ে না। এই রুই মাছটার মরণদশা হয়েছিল। খালের পাশে প্রচণ্ড দাপাদাপি শুনে পরী এগিয়ে গিয়ে দেখে এই কাণ্ড। দু জনে মিলে মাছ টেনে তুলতে পারে না। আর বড়শির টুইন সূতা ছিঁড়ে যাচ্ছে না কেন, সেও এক রহস্য। হৈ-চৈ শুনে শরিফা বেরিয়ে এল। চোখ কপালে তুলে বলল, মাছ। কই পাইছ, এই নুরা?
নুরুদ্দিন হাঁপাচ্ছে, কথা বলার শক্তি নেই।
এই ছেরা, মাছ কই পাইছ?
বড়শি দিয়া ধরলাম।
এই মাছ তুই বড়শি দিয়া ধরছস? কী কস তুই।
নুরুদ্দিন জবাব দিল না।
পরী হাসিমুখে বলল, আইজ খুব বালা খানা করবাম। আজরফরে কইয়াম চাই পুলাউয়ের চাউল আনত। কী কস নুরা?
নুরুদ্দিন সব কয়টি দাঁত বের করে হাসে। শরিফা গলা উচিয়ে ডাকে, আজরফ, ও আজরফ, উইঠা আয়।
আজরফ সারারাত নৌকা চালিয়ে মাছ নিয়ে যায় নীলগঞ্জে। দিনের বেলা পড়ে। পড়ে ঘুমায়। ডাকাডাকি শুনে সে বাইরে এসে অবাক, অত বড় মাছ কই পাইছস নুরা!
লার বড়শি দিয়া ধরছি।
কস কী নুরুদ্দিন।
পরী হাসতে-হাসতে বলল, মাছটার কপালে মিত্যু লিখা ছিল, বুঝছ আজরফ? অখন যাও, কিছু বালা-মন্দ রান্ধনের যোগাড় কর। চাইপডা পোলাওয়ের চাউল আনতা পাবা?
আজরফ গম্ভীর মুখে বলল, মাছটা নীলগঞ্জে লইয়া যাইয়াম। পনর টেহা দাম হইবে মাছটার। নুরুদ্দিন ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, এই মাছ আমি বেচতাম না ভাইসাব।
আমরা অত বড় মাছ দিয়া কী করবাম? বেকুবের মতো কথা কম। ঘরে একটা পয়সা নাই।
কানকোয় দড়ি বেঁধে আজরফ মাছ গাঙের পানিতে ছেড়ে রাখল। নৌকা ছাড়বে আছরের ওয়াক্তে। যতক্ষণ পারা যায় মাছ জিইয়ে রাখা। নূরুদ্দিন কোনো কথা বলল না। আজরফ আবার যখন কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাবার আয়োজন করছে, তখন নুরুদ্দিন চাপা স্বরে বলল, ভাইসাব, মাছ আমি বেচতাম না।
আজরফ বহু কষ্টে রাগ সামলে বলল, এক চড় দিয়া দাঁত ফালাইয়া দিয়াম, এক কথা এক শ বার কস।
আজরফ আছরের আগে আগে মাছ আনতে গিয়ে দেখে খুঁটিতে বাঁধা মাছ নেই। নুরুদ্দিনেরও কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। ব্যাপারটিতে পরীর হাত আছে, বোঝই যাচ্ছে। আজরফ লক্ষ করল, পরী মুখ টিপে হাসছে। আজরফ নীলগঞ্জে যাবার জন্যে যখন তৈরী হচ্ছে, তখন পরী বলল, কয়েকটা টেকা রাইখ্যা যাও আজরফ, পুলাপান মাইনষের সখ। গোসা হইও না।
আজরফ কথার উত্তর না দিয়েই বের হয়ে গেল। কিন্তু দেখা গেল, বালিশের উপর পাঁচ টাকার একটা নোট।
আমিন ডাক্তার দীর্ঘদিন পর আজ ডাক্তারী করে এল। রুগী নয়া কৈবর্তপাড়ার। উত্থানশক্তি নেই এক বুড়ি। দু দিন ধরে প্রবল জ্বর। খাওয়াদাওয়া বন্ধ। আমিন ডাক্তার গিয়ে দেখে বুড়ির যত্নের সীমা নেই। গোটা কৈবর্তপাড়াই বুড়িকে ঘিরে আছে। এক জন পায়ের পাতায় প্রাণপণে তেল মালিশ করছে, অন্য এক জন তালপাখা নিয়ে প্রবল বেগে হাওয়া করছে। আমিন ডাক্তার প্রচণ্ড ধমক দিল পাখাওয়ালা ছেলেটিকে।
নিউমোনিয়া বানাইতে চাস নাকি, অ্যাঁ?
আমিন ডাক্তার তার ব্যাগ খুলে লাল রঙের দুটি বড়ি পানিতে গুলে খাইয়ে দিল। অষুধের গুণেই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক, বুড়ি চোখ মেলল দেখতে দেখতে।
কেডা গো?
এইডা আমিন ডাক্তার, এই দিগরে ইনার মত ডাক্তার নাই।
বুড়ি ক্ষীণ স্বরে বলল, ডাক্তার সাবের শইলডা বালা?