নৌকা সোহাগীর কাছাকাছি আসতেই মতি মিয়া উসস করতে লাগল।
আমরা যে আসছি, তরমায় জানে?
নাহ্।
কিছুই কস নাই?
নাহ্।
মাবুদে এলাহী, বড়ো চিন্তার কথা আজরফ। কামডা ঠিক হইল না। আমি ভাবছি, তর মা বোধহয় নেওনের লাগি পাঠাইছে।
মতি মিয়া গভীর হয়ে তামাক টানতে লাগল। নৌকা ঘাটে আসামাত্র। আজরফকে বলল, আমিন ডাক্তারের সাথে একটা জরুরী কথা আছিল। কথাডা সাইরা আইতাছি, তরা বাড়িত যা।
আজরফের কিছু বলার আগেই মতি মিয়া সরকারবাড়ির আমবাগানে অদৃশ্য হয়ে গেল।
শরিফার স্তম্ভিত ভাব কেটে যেতেই সে চেঁচাতে শুরু করল। সন্ধ্যাবেলাটা কাজকর্মের সময়, তবু তার চিৎকারে ভিড় জমে গেল। এমন ব্যাপার সোহাগীতে বহু দিন হয় নি। মতি মিয়া কোত্থেকে এক মেয়ে নিয়ে হাজির হয়েছে। সেই মাগীর লজ্জা-শরম কিছু নেই, ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে।
কিন্তু যাকে নিয়ে এত কাণ্ড, সে নির্বিকার। যেন কিছুই হয় নি। শরিফার চিৎকার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে ভরসন্ধ্যায় ঘাটে গা ধুতে গেল। হারিকেন হাতে তার পিছু পিছু গেল নুরুদ্দিন। গাঙের পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বলল, আমারে না। দেখলে চিল্লানিটা কিছু কমব, কী কও নুরুদ্দিন?
চিৎকার অবশ্যি কমল না। পরী ফিরে এসে দেখে শরিফা নিজের মাথার চুল ছিড়ছে। নইম মাঝির বউ তাকে সামলাবার চেষ্টা করছে।
পরী বলল, এখন চিল্লাইয়া তো কোনো লাভ নাই। চিল্লাইলে কী হইব কন আপনে? আমি এইখানেই থাকবাম। আমার যাওনের জায়গা নাই।
শরিফা পরপর দু দিন না খেয়ে থাকল। খুনখুন করে কাঁদল পাঁচ দিন, তারপর জ্বরে পড়ে গেল। এই সময় পরী সম্পর্কে তার ধারণা হল, মেয়েটি খারাপ নয়। মতি মিয়ার মতো একটি অপদার্থের হাতে কেন পড়ল, কে জানে।
নুরুদ্দিনকে এখন আর লালচাচীর কাছে ভাত খেতে যেতে হয় না। পরী শুধুমাত্র নরুদ্দিনের জন্যেই ভাতের ব্যবস্থা করেছে। অবশ্যি লালচাচী কিছুদিন হল বাচ্চা রেখে চলে গিয়েছে বাপের বাড়ি। সিরাজ মিয়া আরেকটি বিয়ে করেছে। এই বৌটি বোকাসোকা। বড়ো আদর করে লালচাচীর ছেলেকে। ছেলেটি তবুও রাত-দিন ট্যাট্যা করে। এই বৌনুরুদ্দিনকে খুব আদর করে। নুরুদ্দিনকে দেখলেই বলে, লাড়ু খাইবা? তিলের লাড়ু আছে।
নুরুদ্দিন না বললেও সে এনে দেবে। কাজকর্মে সে লালচাচীর চেয়েও আনাড়ি। এই বৌটিকেও নুরুদ্দিনের খুব ভালো লাগে।
সরকারবাড়ির জলমহালে
কারবাড়ির জলমহালে মাছ মারবার জন্য এক দিন সকালে একদল কৈবর্ত এসে হাজির। সর্বমোট সাতটি নৌকার বিরাট একটা বহর। স্থানীয় কৈবর্ত ধারণাও করতে পারে নি, বাইরের জেলেদের মাছ-মারার ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে। খবর পেয়ে স্থানীয় কৈবর্তদের প্রধান নরহরি দাস ছুটে এল। নিজাম সরকার গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমরার কাছে মাছ ধরার বড় জালই নাই। তোমরা মহালের মাছ ধরবা কী দিয়া?
এইডা কী কথা কইলেন সরকার সাব! মাছ ধরাই আমরার কাম, আর জাল থাকত না? আসল কথাডা কী চৌধুরী সাব?
আসল কথা নকল কথা কিছু নাই, নরহরি। নিজ গোরামের লোক দিয়া আমি কাম করাইতাম না।
আমরা দোষটা কী করলাম? সারা বচ্ছ জলমহালের দেখশোন করলাম। এখন পুলাপান লইয়া কই যাই?
নরহরি দাস হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
বিদেশী কৈবর্ত-দলটি রাতারাতি জলমহালের পার্শ্বে ঘরবাড়ি তুলে ফেলল। গাবের কষে জাল ভিজিয়ে প্রকাও সব জাল রোদে শুকাতে লাগল। ওদের মেয়েরা উদোম গায়ে শিশুদের দুধ খাওয়াতে-খাওয়াতে এমন ভাবে হাঁটাচলা করতে লাগল, যেন এই জায়গায় তারা দীর্ঘদিন ধরে আছে। রাতারাতি নতুন বসতি তৈরী হল। হাঁস-মুরগি চরছে। গরু দোয়ান হচ্ছে। সন্ধ্যার পর খোলা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে গান-বাজনার আয়োজনও হল। ঢোল বাজতে লাগল মধ্যরাত পর্যন্ত।
নরহরি দাস তাদের সঙ্গে আলাপ করে সুবিধা করতে পারল না। সরকারবাড়ির সঙ্গে নরহরির কী কথা হয়েছিল, তা তারা জানতে চায় না। তাদের চার মাসের করে আনা হয়েছে। মাছের ত্রিশ ভাগ নিয়ে মাছ ধরে দেবে, এইটিই একমাত্র কথা। নরহরির যদি কিছু বলবার থাকে, তাহলে তা সরকারবাড়ির সঙ্গেই হওয়া দরকার, তাদের সঙ্গে নয়।
মঙ্গলবার সকালবেলা কৈবর্তদের কুমারী মেয়েরা এলোচুলে জলমহালে নেমে পূজা দিল। পূজার ফলস্বরূপ অসম্ভব মাছ ধরা পড়বে, মাছ মারার কোনো রকম বিষ্ণু উপস্থিত হবে না। প্রথম যে-মাছটি ধরা পড়ল সেটি একটি দৈত্যাকৃতি কাতল। ডালায় সিঁদুর, ফুল এবং কাতলটি সাজিয়ে পাঠান হল সরকারবাড়ি। ঘনঘন উলু পড়তে লাগল নতুন কৈবর্তপাড়ায়।
মাছ মারা হয়েছে পুরোদমে। মাছখোলার পাশে একটি চালাঘর তোলা হয়েছে। আমিন ডাক্তার সেখানে খাতা-পেন্সিল নিয়ে সারা দিন বসে থাকে। কৈবৰ্তরা চিৎকার করে হিসাব মেলায়,
এক কুড়ি–এক
দুই কুড়ি-দুই।
তিন কুড়ি-নি
রাখ তিন। রাখ তিন। রাখ তিন।
চার কুড়ি–চার।
পাঁচ কুড়ি–পাঁচ
ছয় কুড়ি–ছয়।
রাখ ছয়। রাখ ছয়। রাখ ছয়।
আমিন ডাক্তারের ব্যস্ততার সীমা নেই। কত মাছ ধরা পড়ল, কত গেল, আর কত মাছ পাঠান হল খোলায়–সহজ হিসাব নয়। নাওয়াখাওয়ার সময় পর্যন্ত নেই।
খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা চৌধুরীবাড়ির মতো নয়। খাবার দেওয়া হয় বাংলাঘরে। একটি কামলা এসে ভাত দিয়ে যায়। মোটা চালের ভাত আর খেসারির ডাল। মেয়েরা কেউ পর্দার ফাঁক দিয়ে লক্ষ করে না। এই ব্যবস্থা আমিন ডাক্তারের ভালো লাগে। মেয়েরা কেউ পর্দার ফাঁক দিয়ে লক্ষ রাখছে জানলে তৃপ্তি করে খাওয়া যায় না। এখানে সে-ঝামেলা নেই। নিশ্চিন্ত মনে খাওয়া, তবু প্রতি বারেই খেতে বসার সময় চৌধুরীবাড়ির কথা মনে পড়ে।